সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে কোট করার সবথেকে বড় মুশকিল এই যে, ভদ্রলোক এত কিছু ঘটিয়ে গেছেন, যে তাঁকে কোট করতে হলে পলিটিকাল ইনকারেক্টনেস- এর ঝুঁকিটা নিতেই হয়।
শ্রী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, একটা লঘু- কথা বলতে, একজন মাননীয় ও সফল পুরুষ কে ঘিরে তৈরি হওয়া দৃশ্যের আপাত গাম্ভীর্য বোঝাতে লিখতে পারেন, ‘ ভদ্রলোকের গায়ে দামী শাল, পাশে অতীতে ঘুঁটে দিয়েছেন এমন মধ্যবয়সী গম্ভীর স্ত্রী, সোফারও গাড়ি এগিয়ে এনে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে।’ এবং তার সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি চালাচালি ইত্যাদি — সবমিলিয়ে তাঁকে কোট করাটা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট।
যে মানুষ ঘোষিতভাবে ( ভান করে বা ভান ছাড়া), নিজেকে সন্দেহ করেন সবথেকে বেশি, নিজের লেখায় এবং যাপনে দুর্দ্দান্ত ইনকনসিসটেন্ট, এবং তার থেকেও বেশি চেঁচামেচি করে সেই ইনকনসিসটেন্সি উদযাপন করেছেন, তাঁর উল্লেখ সবসময়ই পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ হতে বাধ্য।
কংগ্রেস-এর থেকে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক চিহ্নগুলো একে একে নিয়ে নিয়েছেন শ্রী নরেন্দ্র মোদী। সবরমতী আশ্রমে চরকা কাটছেন প্রধান মন্ত্রী। ছবি সৌজন্য - পি আই বি।
তো, সন্দীপন একবার সার্বভৌম বাংলা ভাষা- রাষ্ট্রের একটি ক্যাবিনেট- এর দফতর বন্টন করেছিলেন।
তাতে গ্রামীণ হস্তশিল্প মন্ত্রক- এর জন্য মনোনীত করেছিলেন জসিমুদ্দিন- কে।
এই ক্যাবিনেট- এর প্রস্তাবিত গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, যিনি, সন্দীপনকে নাকি কখনও ধমকে ছিলেন এই বলে, ‘ অ্যাডভোকেসি কোরো না।লেখার কথা বলবে লোকে। লেখক নয়।’
সন্দীপনের এই ক্যাবিনেট- এর প্রস্তাব নিয়ে, পক্ষে বিপক্ষে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রস্তাবটা যে নিখাদ সন্দীপনীয়, এব্যাপারে কোন তর্কের অবকাশ সম্ভবতঃ থাকবে না।
এই তর্কাতীততা- র আরও প্রমাণ আছে। জীবননান্দকে তিনি দফতরবিহীণ মন্ত্রী করেছিলেন।
এই যে জীবনান্দকে কোন দফতর না দেওয়া, অথচ মন্ত্রী করে রাখার মধ্যে যে সন্দীপনীটা আছে, এটা ধরে নেওয়ার কোন কারণ নেই যে সেটা, তারাশংকর এবং জসিমুদ্দিন- এর মনোনয়ন- এর মধ্যেও থাকবে না।
ফলে, খুব সম্ভব, তারাশংকরের হাতে গ্রামোন্নয়ন থাকলে, গ্রামসমাজ তার সার্বভৌমত্ব চাইবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সদগোপ চাষী, জমিদার থেকে সম্পন্ন চাষীতে অবনমিত বয়স্য, কায়স্থ মুদী মাতব্বর, মাঝখানে জাঁকিয়ে বসা নব্য ধনী ছিরু পাল, এবং একপাশে জড়ো হওয়া হরিজন ক্ষেতমজুরের দল, নিজেদের মধ্যেকার সবরকম বিরোধ নিয়েও, গ্রামীন মজলিশেই গ্রামের সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে। এমনকি অনি কামার আর গিরিশ ছুতোরও, বাদী পক্ষেরই বিচারকের ভূমিকা পালন করা নিয়ে খানিক গাঁইগুঁই করে বয়স ও গ্রামীণ সামাজিক মর্যাদা- র প্রতি সম্ভ্রমে সেটা মেনেও নেবে।সরকারি প্রাতিষ্ঠানিকতা সেখানে তৃতীয় পক্ষ, যার সঙ্গে সম্পর্কটা, ঘোষ ডাক্তারের চিঠি লেখার মতন, খানিক মুখ লুকিয়ে হাসার, ছ্যাবলা অন্তর্ঘাতের।
অন্যদিকে জসিমুদ্দিন প্রগাঢ় মেধা নিয়ে যিনি গ্রামজীবনের বিভিন্ন সাক্ষ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন, ইতিহাসকে চেনেন আদ্যন্ত রোমান্টিকতা দিয়ে, তিনি সম্ভবতঃ ওই তৃতীয় পক্ষের প্রাতিষ্ঠানিকতার ভাষা বোঝেন।
খানিক অভিভাবক সুলভ প্রশ্রয়ে যে প্রতিষ্ঠান সব বিবাদ মিটিয়ে দেবে। সমাজের কোমল পেলবতাগুলো লালন করবে, পুরাতনকে যত্ন করবে, নতুনকে স্নেহ ও প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেবে, দ্বেষ ও ক্রুরতাকে শাসন করবে।
ঔপনিবেশিকতা আক্রান্ত সমাজে ও সময়ে, জনকল্যানকামী রাষ্ট্র ও সরকার- এর ভূমিকা সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত পন্ডিত সম্ভবতঃ এমনটাই মনে করতেন।
ফলে সরকারি মন্ত্রক বা দফতর, তার কিছু উপদেষ্টা সংস্থা যেমন অ্যাডভাইসরি বোর্ড ইত্যাদি, কিছু প্রায়োগিক সংস্থা যেমন ডিরেক্টরেট ইত্যাদি, এগুলোকে সরকারের অভিভাবক সুলভ ভাল উদ্যোগ বলেই মনে করা হয়।
একদিকে শহুরে, আলোকপ্রাপ্ত সমাজ এরকম কোন উদ্যোগকে স্বাগত জানানোই উচিৎ - এরকম একটা যুক্তিকাঠামোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এই সমাজের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই, এই অভ্যাস একটা সৎ বিশ্বাস থেকে আসে। রাষ্ট্র, এবং সেটা পরিচালনার দায়িত্বে যে সরকার, সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রয়োজনীয়তার নিরিখেই সিদ্ধান্ত নেয়। এই বিশ্বাস গড়ে ওঠার একটা দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া আছে।
অন্যদিকে গ্রামসমাজকে বিশ্বাস করানোর আর একটা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, তার নিজস্ব পরম্পরাগত বন্দোবস্তের মধ্যেকার বিরোধগুলোর সমাধান এই সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে।মানে, গ্রাম- শহর, প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলের মধ্যেই এই বিশ্বাস চারিয়ে দেওয়া গেল, যে, সরকারি ব্যবস্থাপনা গ্রামসমাজের বন্দোবস্ত- র থেকে মহত্তর।
প্রস্তাবিত ক্যাবিনেট- এ এই বিশ্বাসের দোলাচল, তারাশংকর আর জসিমুদ্দিনের মধ্যে চাপান উতোর- এ কীভাবে থাকতে পারত সে সম্ভাবনা, সন্দীপনের মাথায় একদমই ছিল না, একথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা কঠিন! যদিও সরকারের মাথায়, বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ- কে রেখে, সন্দীপন তাঁর ইপ্সিত সমাধানের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। সন্দীপনের প্রস্তাবে, বঙ্কিম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন, সেটাও হয়তো খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আরও মজা ছিল অন্যত্র।সন্দীপনের এই প্রস্তাবে কোন অর্থমন্ত্রক ছিল না।
আপাততঃ, আমরা প্রসঙ্গে আসি। প্রসঙ্গ হ্যান্ডলুম বোর্ড।
রাষ্ট্রের জনকল্যানকামিতা ও সরকার সম্পর্কে বিশ্বাস তৈরি করার বিপরীতের বাস্তবটাকে, একটা চালু মজাকে একটু পাল্টে, একবাক্যে ব্যাখ্যা করেছেন, শ্রী বিশ্বেন্দু নন্দ – “কারিগরদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যা সম্পর্ক, মাছের সঙ্গে বাইসাইকেল- এর সেই সম্পর্ক”।
দেখা যাক, বাইসাইকেল সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই কি কি জানি।
হ্যান্ডলুম বোর্ড তৈরি হয়েছে, ১৯৯২- তে।সেসময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা একটু ওয়াকিবহাল তাঁদের স্মৃতিতে থাকতে পারে, এই সময়ের রাজনীতিতে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে, মুক্ত অর্থনীতি, ডাঙ্কেল প্রস্তাব, গ্যাট ইত্যাদি শব্দগুলো।
আর একটু আগে যাওয়া যাক। ১৯৮৯- এর অক্টোবর- এর শেষ দিক। শ্রী এল. কে আদবানি- র রামরথ যাত্রা শুরু হতে তখনও আরও একবছর দেরি। কিন্তু তার প্রস্তুতি চলছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।ভাগলপুর শহরেও চলছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে রামশিলা পুজার জন্য রামশিলা সংগ্রহ কর্মসূচী চলছিল।
এর মধ্যে ভাগলপুর শহরের পারাবত্তি এলাকায় একটা কুয়োয় বেশ কিছু মৃতদেহ পাওয়া গেল। লোকমুখে, স্থানীয় মিডিয়ার সূত্রে মানুষজন জেনে গেলেন, মুসলমানরা হিন্দু ছাত্রদের মেরে, কেটে ফেলে দিয়েছে।
পরে দেখা গেল, মৃতরা সকলেই, ১২ জন- ই, মহম্মদ জাভেদ- এর পরিবারের সদস্য।
১৯৮৯ পূর্ব, পারাবাত্তি- র মুসলিম প্রধান মহল্লাগুলোতে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বসতি।সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির নির্দ্দেশ দেওয়ার অনেক আগেই এই ভূগোল- এর ধর্মাচরণের ধরণ আমূল পাল্টে গিয়েছিল।
১৯৮৯- এর অক্টোবরের শেষ থেকে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রায় ২৫০ টি গ্রাম পুড়েছিল। সরকারি মতে, ১০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যাঁদের ৯০ শতাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিলেন।বেসরকারি মতে অবশ্য মৃতের সংখ্যা ১০০০- এর অনেক বেশি।
বুন্নি বেগম-এর দু হাতে আটটি আঙুল। ২৬ অক্টোবর, ১৯৮৯ যাদের তরোয়ালের কোপ ঠেকাতে আঙুল দুটো গেছে, তারা সকলেই চেনা। কিন্তু কখনও তাদের নাম বলেননি বুন্নি বেগম।বুন্নি বেগমের দিদিরা মরেই গিয়েছিল। আর বুন্নি বেগম মরে গেছে ভেবে, ওরা চলে গিয়েছিল। ছবি সৌজন্য - জাভেদ ইকবাল।
জাভেদ ইকবাল-এর সম্পূর্ণ ফটো-স্টোরি টা এখানে দেখতে পাবেন।
লোগেন, চান্দেরি, রসলপুর, ভাতোরিয়া, ছাজঘরা, সাজোর, শেখপুরা, মকরমডিহি এই গ্রামগুলোতে আগুন লাগলো, দাঙ্গায় যেমন লাগে।
শেখপুরায় মুসলমানেরা থাকে, তাই কারণে বা অকারণে, রুষ্ট হিন্দু জনতা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল এটা বোঝা যায়। কিন্তু পাশেই মুসলিমটোলায়, আরও অনেক মুসলমান ছিলেন, সেখানে কিছুই হলো না।
দেখা গেল ভাগলপুর শহর থেকে শুরু করে, দূরে পুড়েছে একমাত্র সেই গ্রামগুলো, যেখানে মুসলমান রেশম তাঁতীদের বাস। যে মুসলমান গ্রামে রেশম তাঁতী নেই, সেই গ্রামগুলো কে সন্তর্পণে সরিয়ে রেখেই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়েছিল।
আশির দশকের শেষ থেকে সিন্থেটিক রেশম সুতোর চোরাচালান শুরু হয়।চীন থেকে এই সুতো সোজা আসত নেপালে। নেপাল থেকে ভারতে। ফলে, নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি, একটা কোন জায়গা প্রয়োজন ছিল, যেখান থেকে এই সিন্থেটিক রেশম সুতোর বাজার ধরা সম্ভব।ঐতিহাসিক ভাবে রেশমবয়নের জন্য প্রসিদ্ধ ভাগলপুরের থেকে ভাল কোন জায়গা হতে পারত না।
একাংশের রাজনীতিকের সঙ্গে মাফিয়সি- র যোগসাজশের ফলে, ইতিমধ্যেই ভাগলপুরে সিল্ক সিন্ডিকেট যথেষ্ট সক্রিয় ছিল।এবং এধরণের সিন্ডিকেটের ক্ষেত্রে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারার সামর্থ্য যেমন প্রয়োজনীয় হয়, তেমনই, হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোন পরিস্থিতিকে নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর প্রস্তুতি নেওয়ার মতন লোকবল, সামাজিক প্রতিপত্তি, পেশী শক্তি, অর্থ বল এই সবগুলোকে একসঙ্গে জড়ো করতে গেলে, এই সংসদীয় রাজনীতি আর মাফিয়সির মধ্যে এই যোগাযোগটা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।এবং এখানে কে কোন দলের সমর্থক, সেটা সবথেকে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভাগলপুরের সিল্ক সিন্ডিকেটে এই দুয়ের পরিমাণ মতন মিশেল ঘটেছিল। ঘটেছিল বলেই, সিন্ডিকেটের প্রয়োজনে, ১৯৮৪- তে, পুলিশ আধিকারিক ( ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট) সুখদেও মেহেরা- কে পুড়িয়ে মারা সম্ভব হয়েছিল।
ক্রমাগত লোডশেডিং- এ অতিষ্ঠ তাঁতীরা, বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। একজন সাব- ইন্সেপক্টর পদাধিকারী, কে কে সিং, তাঁতীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দ্দেশ দেন। গুলিতে দুজন তাঁতী নিহত হন। এরপরে তাঁতীরা পুলিশের ওপর চড়াও হলে, সাব- ইন্সপেক্টর সেখান থেকে চম্পট দেন এবং গোটা পুলিশ বাহিনীকেই সেখান থেকে নিয়ে যান। তাঁতীদের গোটা রোষটা গিয়ে পড়ে, একলা সুখদেব মেহেরা- র ওপরে, যিনি বিক্ষোভ- এর নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে, তাঁদেরকে যাতে পথ অবরোধ থেকে বিরত রাখা যায় সেই চেষ্টা করছিলেন। একজন ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট যখন আলাপ আলোচনা করে সমস্যার সুরাহার পথ বের করার চেষ্টা করছেন, তখন একজন সাব- ইন্সপেক্টর সেটা সম্পর্কে কিছু জানলেন না, গুলিচালানোর নির্দ্দেশ দিলেন, এবং তারপরে, গোটা বাহিণী নিয়ে পিছু হটে গেলেন সিনিয়রের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু না ভেবে বা না করে, কারণ তিনি তো জানেনই না সিনিয়র ওখানে আছেন, এতগুলো সমাপতন ঘটাতে গেলে ঠিক যা যা দরকার হয়, ভাগলপুর সিল্ক সিন্ডিকেট- এর সেই সবই ছিল। আর ছিল বলে, তাঁতীদের রোষে, সুখদেও মেহেরাকে পুড়ে মরতে হল।কারণ ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট সুখদেও মেহেরা স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন ও মাফিয়সির যোগসাজশে গড়ে ওঠা দুর্নীতির জাল ছিঁড়তে চেয়েছিলেন।
আশির দশকের শেষ দিকে সিন্ডিকেটের ক্ষমতা কোথাও খর্ব হয়নি। খর্ব হওয়ার কোন কারণ ঘটেনি।
কিন্তু এর মধ্যে পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট ইয়ার্ন, কৃত্রিম রেশম, যার পরে বাজারচলতি নাম হবে, কোরিয়ান তসর, নেপাল বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাই দরকার ছিল, রেশম বয়নের চালু কাঠামোটাকে ভেঙে দেওয়া।সংখ্যাগরিষ্ঠ রেশম তাঁতী যদি মুসলিম ধর্মাবলম্বী হন, তাহলে, হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গা সবথেকে ভালভাবে এই প্রয়োজনীয়তাটা মেটাতে পারে।
ফলে ১৯৯০- এর অক্টোবরের রামশিলা- র শোভাযাত্রা, এই প্রয়োজনীয়তাটা মিটিয়ে দিল।ইতিমধ্যেই ধর্মকে কেন্দ্র করে, যে টেনশনটা তৈরিই ছিল, সেখানে শুধু ২০০ হিন্দু ছাত্রকে মেরে কেটে কুয়োয় ফেলে দেওয়ার গুজবটার প্রয়োজন ছিল। স্থানীয় মিডিয়া সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে দিল।পরে জানা গেল, ২০০ জন নয়, মেরে, কেটে কুয়োয় ফেলা হয়েছিল, ১২ জনকে। ১২ জনের কেউই হিন্দু ছিলেন না। সকলেই মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
কিন্তু এই কয়েক সপ্তাহের ধ্বংসলীলা শেষ হলে দেখা গেল,
ছোট তাঁতীরা সকলেই মজুরি শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন, কারিগরি কুশলতার কারণেই যে ব্যবসায় মূলতঃ সংখ্যালঘুদের প্রাধান্য ছিল, সেখানে, তাঁতের সঙ্গে সম্পর্কবিহীণ বিনিয়োগকারীরা ব্যবসাটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেললেন, ভাগলপুরে নতুন রিয়েল এস্টেট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল, পুরোন মুসলিম মহল্লার জমিতে নতুন কলোনি তৈরি হল, যেখানে বেশির ভাগ মানুষই জন্মগত পারিবারিক ধর্মপরিচয়ে মুসলিম নন।
মাফিয়সির নিজের মধ্যেও ক্ষমতার বিন্যাসটা কিছুদিনের জন্য স্থিতাবস্থায় এল। কারণ এই চোরাচালানে যুক্ত প্রায় ৩০০ জন এর মধ্যে খুন হয়ে গেলেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ভাগলপুর পুলিশ প্রশাসন ব্যতিব্যস্ত রইল, এই সিন্থেটিক সুতো চোরাচালানের ভাগ- বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত লড়াইয়ে।
তারপরে আসতে আসতে থিতোতে শুরু করল সব কিছু। চোরাচালানের ব্যবসা স্তিমিত হয়ে এল।
এই ফ্রেমে ভারবর্ষের নতুন যুগের দিশারীদের আর একজনের থাকা খুব দরকারি ছিল। শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। - ছবিসূত্র ইন্টারনেট।
পি ভি নরসীমা রাও এবং মনমোহন সিং, চোরাচালান একেবারে বন্ধ করে দিলেন।
কারণ, পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট ইয়ার্ন আমদানি ততদিনে তাঁরা বৈধ করে দিয়েছেন।
পি ভি নরসীমা রাও- এর, ১৯৯৩- এর দক্ষিণ কোরিয়া সফরে, পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট ইয়ার্ন উৎপাদনের জন্য, কোরিয়ার কোহাপ কর্পোরেশন এবং হায়দ্রাবাদের সঙ্ঘী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিস- এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পাট মানে মিল/কারখানা নয় - তারা ধুঁকছে। সারা বিশ্ব এখন যখন প্লাস্টিকের উল্টোদিক ঝুঁকছে সেখানে বাংলার পাটের ব্যবহার কেন নতুন দিন দেখবে না? দুই দিনাজপুরের প্রায় ১ লক্ষ রাজবংশী মহিলা কোমরে বাঁধা তাঁতে পাট দিয়ে অসামান্য ধোকড়া করেন। বক্তব্য - বিশ্বেন্দু নন্দ। ছবি সৌজন্য - বিশ্বেন্দু নন্দ।
পলিয়েস্টার সুতোর আমদানি বৈধ করা, এবং তার উৎপাদনের জন্য পুঁজি ও প্রযুক্তি কে নিশ্চিত করার এই সময়ের মধ্যে অবশ্য ১৯৯২ সালে তৈরি হয়েছে, হ্যান্ডলুম বোর্ড।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই, যে ভাগলপুরে রেশম বোনার যেটুকু পরিকাঠামো টিঁকে ছিল, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত হঠাৎই তার কাপড়ের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে গেল। আর কী আশ্চর্য! দেখা গেল এই বাড়তি চাহিদার গোটাটাই অপেক্ষা করছিল, চীন এবং কোরিয়ার পলিয়েস্টার রেশমের কাপড়ের জন্য। কারণ দেশি তসরের চাহিদা একটুও ছিল না, যা চাহিদা ছিল, সবই ওই পলিয়েস্টার রেশম কাপড়ের, যার আজকের চেনা নাম, কোরিয়ান তসর।
নিশ্চিতভাবেই, হ্যান্ডলুম শিল্পের উন্নতির লক্ষ্যে, অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড নামে, যে উপদেষ্টা সংস্থা তৈরি হয়েছিল, ১৯৯২- এর জানুয়ারিতে তারা তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্য ঠিকঠাকই পালন করছিলেন।