বইঘর
কথোপকথন-এর ভাবনা-টার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল, বিভিন্ন বিষয়ে এই চর্চাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্রের।সেই সূত্রে বাছাই বই-এর সংগ্রহ হিসেবে তৈরি হয়েছিল, কালিকলমমন বইঘর। যেখানে বিষয়ভিত্তিক বই থাকবে। নতুন বই-এ না কুলোলে, পুরোন বই-ও থাকবে, যদি সংগ্রহ করা যায়। বইঘরে, বই পড়া যাবে, প্রয়োজনে কেনা যাবে।
খুব তাড়াতাড়িই বোঝা গিয়েছিল, কথোপকথন-এর নির্বাচিত বিষয়গুলি নিয়ে চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বই-এর সংখ্যা সমসাময়িক প্রকাশনার মধ্যে খুবই কম। বাংলাভাষায় তো আরও কম। অথচ, কথোপকথন-এর চর্চাগুলোতে যাঁরা যোগ দিচ্ছিলেন, তাঁদের সূত্রে পুরোন বই-এর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল। যেখানে সম্ভব, অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের সংগ্রহ থেকে বই এনে রাখছিলেন। বই কেনার সঙ্গে বই বিনিময়ও শুরু হয়েছিল। কিন্তু এগুলো কোনটাই প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না।
দ্বিতীয় আর একটা সমস্যা আসতে আসতে বড় হয়ে উঠছিল। সেটা হল, বই-এর নির্বাচন। একদিকে, প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে জ্ঞানচর্চার ওপরে যে সমস্ত শর্ত আরোপিত হয়, সেগুলোর ওপরে যাঁরা প্রয়োজনের থেকে বাড়তি গুরুত্ব আরোপ করেন, তাঁরা তাঁদের মতের সমর্থনে যে সমস্ত বই-এর উল্লেখ করতে অভ্যস্ত, বইগুলো লেখার সময়টা, বা সেই বইগুলো যাঁরা লিখেছেন তাঁদের বোঝাপড়ার ঠিক-ভুল ইত্যাদি নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠলেই তাঁরা হয় সিঁটিয়ে যাচ্ছেন, নয় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন।
প্রতিকূল পরিবেশ, তেমন তেমন ক্ষেত্রে শুধু হতোদ্যম করে না। প্রতিক্রিয়ায় একরকমের বেপরোয়া উচ্চাকাঙ্খারও জন্ম দিতে পারে। এক্ষেত্রেও এরকম একটা ব্যাপার হল।
যে দুটো জিনিস বোঝা যাচ্ছিল,
১। কথোপকথন-এ অপ্রাতিষ্ঠানিক রকমে যে চর্চাটাকে ঘটিয়ে তুলতে চাওয়া হচ্ছে, তার তৈরি রসদ খুব বেশি নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক যেগুলো সেগুলোর সম্পর্কে জানাশোনা কম। আর যেগুলোর সম্পর্কে জানাশোনা বেশি, সেগুলোর বেশিরভাগই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট – কোন না কোন অ্যাজেন্ডাকে জিতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আর হয়েছে বলেই, পরবর্তীতে সেগুলোই বেশি পরিচিত হয়েছে, চর্চায় এসেছে, আরও পরিচিত হয়েছে। এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচচর্চা যেহেতু একরকমের আনুগত্য দাবী করে ফলে বইগুলির বিষয়বস্তু যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে, তার থেকে বড় হয়ে উঠেছে, লেখকের সার্টিফিকেশন।এবং পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ পরিস্থিতিতে, দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী শ্লাঘা, সিরিয়াস বাংলা বই (অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রকাশ মাধ্যমগুলোর মতনই) সংক্রান্ত এই সার্টিফিকেশনের প্রক্রিয়াকে, একরমের অ্যাকাডেমিক মান্যতা দিয়েছিল।
তাই, প্রথম যে বেজায় উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্পটা তৈরি হয়েছিল, সেটা এরকম, বিষয়ভিত্তিকভাবে, কোন একটি বিষয়ে পরিচিত টাইটেলগুলোর লেখক, সময় এবং হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া নিয়ে একটা নৈর্ব্যক্তিক ডকুমেন্টেশন তৈরি করা।
২। কলকাতা কমন্স-এর শুরুর দিনগুলোতে যখন শুধুই রিসার্চ কালেক্টিভ নামে আমরা কাজ করতাম, কাজের সূত্রে যখন প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিক্স-এর সঙ্গে মোলকাত হত, একটা প্রশ্ন খুবই বিরক্ত করত। আমরা যদি অঙ্কই করি, আর কোড-ই লিখি, তাহলে ইতিহাস খুঁজি কেন?
বা আমরা যদি ইতিহাস খুঁজি, তাহলে, নদীর নাব্যতা আর নৌকার গড়নের প্লবতা নিয়ে মাথা ঘামাই কেন? যদি আলাদা আলাদ ভৌগলিক অঞ্চলের উৎপাদন ও বিনিময়ের তথ্যই যোগাড় করি, তাহলে, কোন অঞ্চলের সুরে গসপেল-এর প্রভাব ধরে, মিশনারীদের আসার সময়টা নিয়ে কৌতুহল দেখাই কেন?
ডেভলেপমেন্ট ইকনমিক্স-এর থিওরিতে ডেভলেপমেন্ট-এর পারসেপশন বুঝতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট-এর সঙ্গে আমাদের কি কাজ থাকে?
বাধ্য হয়ে, রেজিস্ট্রেশনের সময়ে নামের সঙ্গে লেজুড় হিসেবে, ইন্টারডিসিপ্লিনারি শব্দটা জুড়ে দেওয়া হয়।
এটা জেনেই যে, প্রাচ্যের উপনিবেশপূর্ব জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে, ইন্টারডিসিপ্লিনারি শব্দটার কোন আলাদা তাৎপর্য নেই।কারণ সামাজিকভাবে জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়াটার মূল বৈশিষ্ট্যই ছিল তার ইন্টারডিসিপ্লিনারিটি। ছিল ভীষণ স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, উদ্বৃত্ত উৎপাদনের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক বোঝাপড়া মতন ডিভিশন অব লেবারের মাহাত্ম্যকীর্তন করা হয়নি। হয়নি বলেই, আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে চর্চাগুলো, খুব সহজ সাবলীলভাবে, এক ডিসিপ্লিন থেকে অন্য ডিসিপ্লিন-এ যেতে পারতো। চর্চা-র অধিকারী হওয়ার শিক্ষাটা জরুরি ছিল, চর্চার বিষয়ভাগ নয়। আমরাও এই প্রক্রিয়াকে জেনেছি বই থেকে, অ্যাকাডেমিয়ার মধ্য থেকেই। তারপরে সেটা হাতে কলমে শিখতে চেয়েছি, চর্চা করতে চেষ্টা করেছি। এবং দেখেছি, কোডার-এর পক্ষে ইতিহাস বোঝা, আর ইতিহাসের ছাত্রের পক্ষে প্লবতা বোঝা-টা তেমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু, সচেতন চেষ্টাটা থাকা প্রয়োজন।কিন্তু অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেমিনারে, ওয়ার্কশপে যাঁদের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হচ্ছে, তাঁরা ডিভিশন অব লেবারে বিশ্বাসী। ফলে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও সেই ডিভিশন-টাতেই তাঁরা ভীষণ বিশ্বাস করেন। প্রয়োজন কিনা তেমন করে কখনও ভেবে দেখেননি। স্পেশালাইজেশনকে তাঁরা তাই চর্চার ধারাবাহিকতায় দেখেন না, দেখেন, ফ্যাকাল্টির নামকরণ দিয়ে।
তাই, দ্বিতীয় উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্পটা ছিল, কথোপকথনের চর্চার বিষয়বস্তুগুলো ধরে, বিভিন্ন রকমে সেটাকে ডকুমেন্ট করা। স্বাধীন স্বকীয় কোন লেখার প্রয়োজন ছিল না। সুবিমল মিশ্রের কথা অনুযায়ী, ‘লেখা কখনোই মহৎ হয়ে না ওঠা’-টাই এখানে মূল প্রয়োজন ছিল।
এই দুটোই কোন একজন বা কয়েকজনের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এই দুটো কাজই একমাত্র সম্ভব, একটা সামাজিক উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। আর এই উদ্যোগের ফলাফলগুলোকে প্রয়োজনীয় রকমে সবথেকে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ই-বুক ব্যাপারটাই সবথেকে উপযোগী বলে আমাদের মনে হয়েছিল।
দুটো জায়গায় ব্যাপারটা আটকালো। ইন্টারনেট-এর সৌজন্যে প্রয়োজনীয় বই যোগাড় করাটা ততটা কঠিন হচ্ছিল না, যতটা সমস্যা তৈরি করছিল, বাংলা OCR-এর কাজ। বাংলাভাষায় কম্পিউটেশন-এর কাজ, বিশেষতঃ এই ইউনিকোড যুগেও এত প্রিমিটিভ যে, সেটার জন্য আমরা যথেষ্ট রসদ সংগ্রহ করতে পারার আগেই, করোনা চলে এলো।
ফলে গোটা উদ্যোগটা কে অনলাইনে সরিয়ে আনতে হলো। এই করোনার সময়টা জুড়েই বিভিন্ন মানুষ, ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা সাংগঠনিক ভাবে, অনলাইনে বিভিন্নরকমের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরকম বেশ কিছু উদ্যোগের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। দেখা গেল, এঁদের এই উদ্যোগগুলির অনেকে মিলে একটা দুরন্ত সম্ভার তৈরি করে ফেলেছেন, এই করোনা আক্রান্ত সময়ের মধ্যেই।
এবং আমরা যেহেতু সামাজিক উদ্যোগে আস্থা রাখি, তাই , এই ব্যক্তিগত ও সংঘবদ্ধ উদ্যোগগুলির সঙ্গে জুড়ে কালিকলমমন-বইঘরের উদ্যোগটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।
আমরা বই-এর সূচী প্রকাশ করব। বিযয়ভিত্তিক রীডিং লিস্ট-ও তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেটা একটা সংঘবদ্ধ উদ্যোগ হিসেবে।তালিকার কোন বই যদি কেউ পেতে চান, তার চেষ্ট করা হবে।
কিন্তু আমরা তার সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিতে চাই। বই-এর বিনিময়ে পাঠককে কিছু সময়ের শ্রম দিতে হবে। আমরা একটা গুগুল ফর্ম রেখেছি। এটাতে নিজের পড়া বইগুলো সম্পর্কে যদি জানান, তাহলে বাকিরাও উপকৃত হবেন।
এই ফর্মটি পূরণ করুন। https://forms.gle/jX4ut3BUmgfQTGxV9
মেটাডেটাগুলোর প্রভিশন রাখা হয়েছে মূলতঃ দুটো কারণে। কোন প্রকাশনী, কোন সময়ের এগুলোও বিষয়বস্তুকে যেভাবে দেখা হয়েছে, সেটা বুঝতে সুবিধে করে। আর পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় বই খুঁজে পেতে গেলে, সার্চ/ফিল্টারিং গোছের কোন অ্যালগরিদম তৈরিতে সুবিধে হতে পারে। তবে তার জন্য ডেটা ক্লিন করার একটা কাজ থাকে।সকলে যদি বিষয়টাকে প্রয়োজনীয় মনে করেন এবং ব্যাপারটায় সহযোগিতা করেন, তাহলে, সেটা করা সম্ভব। এখনও অবধি এরকমভাবে, যতগুলো বই-এর নাম জড়ো হয়েছে, সেগুলো এই বুকলিস্ট-এ পাওয়া যাবে। https://docs.google.com/spreadsheets/d/1pU-dGX2Q5NRmAXBgSDdANuvDovQiP6-rU0rBhSRKnYk/edit?usp=sharing
উপনিবেশ বিরোধি চর্চা-র দুটো রীডিং লিস্ট তৈরি হচ্ছে।
১৭৫৭ পর্যন্ত। https://docs.google.com/spreadsheets/d/1o21RioDBUmcSNCoRiNmQfU_YcGKcnX-RZXjD1lwPo7E/edit?usp=sharing
১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। https://docs.google.com/spreadsheets/d/1yQE84nIsKWiyuxYNDdd4FzhZCHE6Ly-JMGr-EeHUM_M/edit?usp=sharing