এমনিতেই কৌশিকী অমাবস্যা পড়ে গিয়েছে। কী বলতে কী হয়! সাঁঝ লাগছে এমন সময় হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে কর্তাগিন্নী যেই উপস্থিত হলাম DW Studios, দুম করে শুরু হয়ে গেল ঢপের থিয়েটার।কী দেখলাম? উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ারের বিনির্মাণ? কাপ্তেনবাবু আর বীরকৃষ্ণ দাঁয়ের একপেশে খেলার হাইলাইটস এই সময়ের পর্দায়? নাকি এই থিয়েটার দেখার চেয়ে বেশী কিছু। ইন্টিমেট থিয়েটারে স্টেজ আর চেয়ারের কোনোও দূরত্ব নেই। ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে আজকের ময়নাকে যখন শরীরের নানা ভাঁজে আঘাত করে আঙুর, সহ্য হয় না, চোখ ফিরিয়ে নিই কেন বারবার? আমাদের আঙুলের ডগায় ফেসবুক ইউটিউব নেটফ্লিক্স এর চেয়ে অনেক ঘোরতর হিংস্র দৃশ্যের নেশা লাগিয়ে আমাদের বিঞ্জ ওয়াচ করায়। তাহলে ইন্টিমেট থিয়েটারের ধরনটাই এটা যে দর্শক ঐ পরিধির মধ্যে ঐ ফিকশনের অংশ হয়ে যায়? দূরত্বটাই মায়াবাস্তব তৈরী করে তাহলে? ইন্টিমেট থিয়েটার এক আশ্চর্য সামাজিক এক্সপেরিমেন্ট বটে।
তাই সত্যি বলছি মশাই, কিচ্ছু দেখিনি। ফ্রাঙ্কার গল্প বলতে বলতে সূত্রধর যখন নটীদের পায়ে আলতা পরান, আমার গা শিরশির করে ওঠে। মেঘনাদবধ কাব্য আবৃত্তি করতে করতে ময়না যখন বিড়ি জ্বালাইলের বিভঙ্গে মেতে ওঠে, আমার ভয় করে। প্রিয়নাথের কানের নীচে সূত্রধর যখন সপাটে চড় কষায়, আমার রাগ হয়। আমি চোখ সরিয়ে নিই। কারণ এই অনুভূতিগুলো এইভাবে পেতে আমি অভ্যস্ত নই। বিনোদন কখন এমন অস্বস্তি দেয়?
এটা একেবারে নতুন। অন্যরকম। ডিটক্স শট কবে আর চেখে মোলায়েম লেগেছে?
ভাষা সন্ত্রাস এই পারফর্মেন্সের একটা পিলার। ইংলিশ মিডিয়াম ময়নার মুখে চামচ ঢুকিয়ে ‘র’ উচ্চারণ শুধরে পবিত্র ‘রবি’ উচ্চারণ করানো হয়। শহরের বিনোদনে আমরা ‘স’সচেতন উচ্চারণ পছন্দ করি। আমাদের পছন্দের বেশীর ভাগ চরিত্রই আমাদের মত, ‘স’সচেতন পরিশীলিত ভদ্রলোক। বাকি গুটিকতক ঝিচাকরের পার্টগুলোতে স্ স্ করলেও হয়, না করলেও ওরা ছোটলোক। ও নিয়ে আমাদের বিশেষ কুসুমদোলা নেই। সেই টিনের তলোয়ারের অন্ধকার ডায়লগটা কানে বাজে “আমি কলকেতার তলায় থাকি”।
থিয়েটারের হিপোক্রেসিটা আর একটা পিলার ঢপের থিয়েটারের। নট বিনোদিনীর তিলতিল করে জমানো অর্থে গড়া তাঁর স্বপ্নের নাম কেন স্টার থিয়েটার, কেন সেখানে নটীর নাম সুবিধেজনকভাবে বিস্মৃত সে কথা মনে করালেন সূত্রধর। বাদল সরকারের এক্সপেরিমেন্টের বিরুদ্ধে কীভাবে নাট্যসম্রাটরা কাঁকড়ার ভূমিকা নিয়েছিলেন সেই কথা বলে ঢপের থিয়েটার। কেমন করে থিয়েটারের শুকিয়ে আসা শিরাগুলো সিনেমা সিরিয়ালের সাপ্লাই চেন অব্যাহত রাখছে তার বর্ণনা শোনা যায় ঢপের থিয়েটারে।
ঢপের থিয়েটার তাই বিপজ্জনকভাবে ইন্টিমেট। আমাদের রোজকারের আপোষ পরাজয়ের ঘাগুলোতে হুড়হুড় করে গ্রে গুজ ঢেলে দেয়। আপনার মশাই হাঁসফাঁস অবস্থা, তার তোয়াক্কাই করে না। এই এত সাবধানবাণী শোনানোর পরেও যাঁরা জিজ্ঞাসা করবেন আমার কেমন লেগেছে তাঁদের বলি- ডিটক্সের পরে আপনি কী বলতে কী করে বসবেন সে দায় মশাই আমার নয়। নেহাত সেই যদি নাছোড় হন দেখুন তবে, যদি পরের বার লাকি ফিফটিনের একজন হয়ে আসতে পারেন। দায় আপনার কিন্তু। জরুরী অবস্থায় বাদলবাবুদের নাটক দেখে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিয়ে পরে পুলিশ এনে তাদের চিনিয়ে দেওয়া দর্শকদের রক্তের দাগ আমার মত আপনার হাতেও আছে। ঢপের থিয়েটার তার শোধ নেবে, সাধু সাবধান।