অতিথি পুলিশ আধিকারিক বললেন 'I love lock-up'। কেন না, লক আপের পেছনে অপরাধ চলে যায় বলে নাগরিক কিছু শান্তি-স্বস্তি পেয়ে থাকে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষটি শুনেছিলেন পুলিশ মানেই দুর্নীতিগ্রস্ত। করবেন না করবেন না করেও শেষে পুলিশের চাকরী নিয়েছেন। একটাই ব্রত, অপরাধ মোকাবিলার। এবং উনি খুব পরিস্কার জানেন উঁচু উঁচু স্কাইরাইজে বসে থাকা হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের চাইতে বড় চোর-ডাকাতও না। দৃপ্ত হয়ে ওঠা মানুষটিকে এরপরেও আমাদের জানাতে হয় পুলিশ ও বিচারক তো এক নয়। দুটো কাজ একহাতে চলে গেলে যে পর্বান্তর হয় তাতে আইনের সীমানা লঙ্ঘিত হতেও পারে/হয়ে থাকে। অতিথি আরেক বন্ধু অফিসার জানালেন সেই ঘটনা যেখানে অন্যায্যভাবে কাউকে অপরাধী করার প্রচেষ্টা তাঁরা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কেমন করে রুখেছেন।
এত আইনের কথা কেন? কেন না গতকাল ডি ডাবলু স্টুডিওতে নিরানব্বই বছর বয়সী আমাদের এক ঠাকুমা এসেছিলেন রূপকথার গল্প শোনাতে। যে গল্পের শেষে ছিল সেই চিরাচরিত কথা 'অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল'। সকলেই জানি এমন শুধু রূপকথাতেই হয়। বাস্তবে হয় না। হয় না বলেই আইন-পুলিশ-আদালত এই সব লাগে আমাদের। লাগে শাস্তিমূলক এক ব্যবস্থার। ভীতিমূলক এক ব্যবস্থার। সে কি পুলিশ ভয় দেখায় বলে? নাকি আমরাও ভয়ে থাকার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে রাখি বলে? এও তো জানার ছিল।
অতিথি পাঠক বললেন ট্যাক্সিওলা বাড়তি ভাড়া চাইছিল। তিনি দেবেন বলে তাঁকে নিয়ে গেছিলেন এক সার্জেন্টের কাছে বুদ্ধি করে। সার্জেন্ট তখন এই বে-আইনী কাজ বন্ধ করিয়ে ট্যাক্সিওলাকে আইন মানালেন। সেই পাঠকের কাছে জানতে চাওয়ার ছিল প্রথমে দাবী মেনে নিয়ে পরে তা না রাখা প্রতিশ্রুতিভঙ্গ নয়? ন্যায্য কাজের জন্য ব্যবহৃত পন্থাটি অন্যায্য নয়? সমবেত পাঠকদের কাছে জিজ্ঞাস্য ছিল কেউ এমন আছেন কী না যিনি কখনোই সামান্য দুর্নীতিও করেননি, আইন ভঙ্গ করেননি সজ্ঞানে।
কেন এত কথা? আসলে 'পুলিশ খারাপ আমরা ভাল' বা 'আমরা খারাপ পুলিশ ভাল' এমন এক সহজ বাইনারিতে যাবার আগেও খেয়াল করা দরকার আমাদের মুখগুলি আয়নায় আমাদের কাছেও স্পষ্ট না। স্পষ্ট নয় বলেই ছোট ছোট 'অফেন্স' জমা হতে হতে একদিন ক্রাইম-ও জন্মায়। আবার আমাদের 'অফেন্স'গুলো জন্মায় হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের হাতে সব ব্যবস্থা প্রায় চলে যাওয়াতে তারা যা খুশী করতে পারে বলে। ওটাই রাস্তা হয়ে গেছে। যে যাই বলুক, প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতিটাই আসল নীতি, ওটা ছাড়া দু-পা চলাও আজ কঠিন।
তাহলে 'যা হতে পারত' দেশ, আর 'মা যা হইয়াছেন' এই ফাঁকটুকুর মধ্যে যে বিস্তির্ণ ধুসর অঞ্চল সেখানেই পড়ে থাকে বিনোদ ঘোষালের 'লকআপ কিংবা রূপকথার গল্প', তাই না? যখন পড়বেন তখন সেই ধুসরতার কথা মনে না রাখলে পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কাল অভিযান পাবলিশার্স-এর এ বই-এর উদ্বোধন হল। ফিতে কাটার আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে পাঠক ও লেখকের উপস্থিতিতে আমরা চেয়েছিলাম এই বই নিয়েই ভিন্নতর এক আলোচনা হোক। বই-এর বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, লেখকের মনস্বীতা এবং পাঠকের অবস্থান উঠে আসুক সেখানে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্যায়ে 'তথ্য-কল্প-গল্প'-এর আড্ডার সময় ঠিক এই কারণেই অনুবীক্ষণের তলায় ফেলা হয়েছিল সমবেত লেখক কূলকে। দেখতে চাওয়া হচ্ছিল লেখা নিয়ে তাঁরা কতটা নিষ্ঠ, কতটা রক্তপাত তাঁরা সহ্যে সক্ষম। এমন মানবসমাজের সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে লিপিকার হয়ে ওঠা তো নিতান্তই সহজ কাজ নয়। দিনগত পাপক্ষয়ের হিসেবের খাতা বা ব্যবসায়ীর হালখাতায় কেউ সাহিত্য আশা করেন না, লেখকের কাছে করেন। তাই এই চিরে চিরে দেখা। এই দেখা পাঠকের জন্যও। এবং আগামীতে পাঠকের কথা শোনার জন্যও এমন কিছু ভাবনা আমাদের আছে। আমরা মনে করি 'বই আমাদের বৈভব'। কথোপকথন-এর তরফ থেকে বাংলা প্রকাশনায় বই প্রকাশ এবং বাংলা সাহিত্যের প্রচার-প্রসারকে এভাবেই আমরা বাড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছি, বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট প্রকাশিতব্য বই-কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকদের সহায়তা পেলে বাংলা সাহিত্যের ছায়াছবি নয় রক্তমাংসের কথা আমরা এভাবেই তুলে ধরব ভবিষ্যৎ-এও।