শিশু অধিকারের দাবীসনদ, কথোপকথন-এ গৃহীত প্রস্তাবগুলির চূড়ান্ত খসড়া।
মতপ্রকাশের অধিকার, স্বাধীনতা ও প্রতিষ্ঠান
১। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্থানীয় প্রশাসন স্তর থেকে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত, গৃহীত নীতিগুলির পর্যালোচনা করতে হবে। এবং সেই প্রক্রিয়ায় শিশুদের সামিল করতে হবে।
২। শিশুদের চিন্তাশক্তি বাড়াতে এবং তাদেরকে উদ্যোগী করে তুলতে তাদের মতপ্রকাশে উৎসাহিত করতে স্কুলস্তরে শিশু সংসদ গঠন করে কার্যকরী ভাবে পরিচালনা করতে হবে।
৩। স্কুল ম্যানেজিং কমিটি বা ভিলেজ লেভেল প্রোটেকশন কমিটিতে শিশুদের অন্তর্ভুক্তির নিয়মকে অবিলম্বে কার্যকরী করতে হবে।
৪। স্কুলের সঙ্গে স্থানীয় সমাজের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া বিশেষ জরুরি। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী মানুষদের নিবিড় অংশগ্রহণ ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের মাধ্যমে স্কুলের পঠনপাঠন এবং অন্যান্য কার্যকলাপের মান আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
শিশু সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনি বন্দোবস্ত ও প্রতিষ্ঠান
৫। শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট সরকারি হোমগুলিকে প্রকৃত অর্থে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। পরিবারের সঙ্গতি না থাকলেও, সরকারের দায় এড়ানোর জন্য যে কোন অজুহাতে বাচ্চাকে পরিবারের কাছে ফেরৎ পাঠানো চলবে না।
৬। জুভেনাইল প্রোটেকশন অ্যাক্টে পুরুষ ও মহিলা শিশুদের সঙ্গে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার পরিচয়সম্পন্ন শিশুদের জন্য আদার্স ক্যাটাগরির প্রবর্তন করতে হবে। এবং এই ক্যাটাগরির জন্য আলাদা হোম-এর বন্দোবস্ত করতে হবে।
৭। জুভেনাইল জাস্টিস আইনে নাবালক অপরাধী বিবেচনার বয়সসীমা ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করা চলবে না। সমস্ত শিশুর জন্য শিক্ষা এবং সুষ্ঠু শৈশব নিশ্চিত করে শিশুদের মধ্য অপরাধপ্রবণতা কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। হোমগুলোতে শিশুদের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাউন্সেলিং-এর জন্য অভিজ্ঞ কাউন্সেলর নিয়োগ করা জরুরি। এর সঙ্গে তাদের সামগ্রিক মনঃসামাজিক বিকাশের জন্য প্রকৃত জীবনকুশলতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৮। শিশুপাচার এবং বাল্যবিবাহ রোধে, পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে চাইল্ড প্রোটেকশান কমিটির জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৯। চাইল্ড লাইন ও চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
১০। শিশুদের বেড়ে চলা ইন্টারনেট ভিত্তিক কার্যকলাপের সঙ্গে তাল মিলিয় শিশুদের জন্য অনলাইন সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে।
অতিমারী ও আম্ফান সংক্রান্ত বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলা
১১। যথাযথ নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করে, অবিলম্বে আই সি ডি এস থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল খোলার বন্দোবস্ত করতে হবে।
১২। স্থানীয় সরকার (পঞ্চায়েত, পৌরসভা) ভিত্তিক মনিটরিং কমিটি তৈরি করে, করোনাকালে স্কুলছুট শিশুদের স্কুলে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
১৩। করোনাকালে দীর্ঘসময়ে স্কুলের পঠনপাঠন বন্ধ থাকার কারণে, যে ছেদ তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৪। সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে কোভিড নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
১৫। আম্ফানের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গুণমানের দিকে নজর দিতে হবে
শিক্ষার অধিকার ও শিক্ষা পরিকাঠামো
১৬। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের ভূমিকাকে খর্ব করে কেন্দ্রীভূত শিক্ষা প্রণয়নের নয়া শিক্ষানীতির প্রয়োগ এই রাজ্যে বাতিল করতে হবে। রাইট ফর চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কম্পালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯ অবিলম্বে যথার্থ ভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়ে তদারকির জন্য স্টেট কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস্-কে আরও দায়িত্বশীল ও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে।
১৭। শিক্ষার বেসরকারিকরণ করা চলবে না। সরকারি উদ্যোগে, জনজাতি, দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আর্থিক ভাবে পশ্চাদপদ এবং বাধ্যতামূলক ঋতুকালীন অভিবাসী মহিলা শ্রমিকদের শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার মতন গ্রামভিত্তিক সরকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরতা মায়েদের সন্তানদের জন্য শিশুকেন্দ্র-র বন্দোবস্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১৮। পাঠক্রম থেকে সমস্ত অপ্রমাণিত ইতিহাসের দাবী বা অবৈজ্ঞানিক তথ্য বাদ দিতে হবে। প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে জনজাতি, দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারীসমাজ এবং প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার নাগরিকদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে। এবং এর বিরোধী যে কোন বিষয়বস্তু পাঠক্রম থেকে বাদ দিতে হবে।
১৯। ছয় বছরের নীচে প্রত্যেক শিশুকে সরকারের তত্ত্বাবধানে মানসিক বিকাশের উপযোগী শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২০। প্রত্যেক শিশুর আগ্রহ এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শিশু বয়সে, অক্ষমতার পরিবর্তে সক্ষমতার ধারণাগুলি তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক হতে পারে। এবং তার পরবর্তী শিক্ষাজীবন এই সক্ষমতার ওপরেই ভিত্তি করে তৈরি হয় এমন শিক্ষা কাঠামো প্রণয়নের পরিকল্পনা করতে হবে।
২১। শিক্ষার বিবিধ সরঞ্জাম তৈরির জন্য স্থানীয় কারুশিল্পীদের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য ব্যবহার করার মতন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে।
২২। প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে সমস্ত স্তরের শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য নিয়মিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ-এর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে এবং তা কার্যকরী করতে হবে। এব্যাপারে স্থানীয় সমাজের শিক্ষিত যুবক যুবতীদের সামিল করতে হবে। সংগীত চারুশিল্প কারুশিল্প পুতুলনাচ নৃত্য, এইসব সৃষ্টিশীল কাজে শিশু কিশোরদের উৎসাহী করে তুলতে, স্থানীয় সমাজের লোকশিল্পীদের সামিল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
২৩। শিশু শিক্ষায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ যথায়থ ও নিয়মিত করতে হবে। অন্তত তিনমাসে একবার শিক্ষক-প্রশিক্ষণের নির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকা দরকার। স্কুলস্তরে শিশুকিশোরদের নানাবিধ মনঃসামাজিক সমস্যায় সাহায্যের জন্য স্কুলেরই আগ্রহী এবং সংবেদনশীল কয়েকজন শিক্ষকশিক্ষিকাকে মানসিক স্বাস্থ্য, কাউন্সেলিং এবং জীবনকুশলতার প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কুলে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা এবং জীবনকুশলতা শিক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।
২৪। ১৪ বছরের পরেও ন্যূনতম মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে।
২৫। অনলাইন পড়াশুনোর ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিষেবা ও উপকরণের অভাবে মেয়েদের জন্য পড়াশুনোর সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। মেয়েরা যাতে এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে পড়াশুনোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য যত্ন নিতে হবে। করোনা অতিমারীর সময় বিশেষ করে ছাত্রীদের স্কুলছুটের ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। এই সমস্ত ছাত্রীকে স্কুলশিক্ষার মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা নিতে হবে।
২৬। প্রাইমারি ও হাই স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর সংখ্যা বড়াতে হবে। সমস্ত শূণ্যপদে অবিলম্বে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
বিশেষভাবে সক্ষম ও বিশেষ (শারীরিক ও মানসিক) চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত
২৭। বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে, স্পেশাল এডুকেশন-কে শিক্ষা দফতরের আওতায় আনতে হবে।
২৮। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয় বস্তুতে বিশেষ ভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের বিষয়টি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২৯। বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে নিযুক্ত প্রশিক্ষক (স্পেশাল এডুকেটর)-দের বেতন কাঠামো সংশোধন করতে হবে, এবং তাঁদেরকে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করতে হবে।
৩০। পশ্চিমবঙ্গে RPWD অ্যাক্ট-কে যথাযথ ভাবে লাগু করতে হবে।
৩১। পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত জনসংখ্যার ভিত্তিতে স্পেশাল এডুকেশন রিসোর্স রুম এবং স্পেশাল এডুকেটরের বন্দোবস্ত করতে হবে।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য
৩২। যে কোন ধরনের দূষণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি মূল্য দেয় শিশুরা। শৈশব যাতে দূষণমুক্ত থাকতে পারে, তার জন্য সরকারী স্কুলগুলোতে মিড-ডে মিল-এ রাসায়নিক দূষণমুক্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
৩৩। শিশুদের মধ্যে সুস্থ পরিবেশচেতনা গড়ে তোলার মতন পাঠক্রম প্রবর্তন করতে হবে।
৩৪। গ্রাম ও স্কুল স্তরে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট-এর কাঠামো করতে হবে
৩৫। সাব হেল্থ সেন্টারে চিকিৎসক নিয়োগ বাড়াতে হবে।
সংখ্যালঘু ও পশ্চাদপদতা সম্পর্কে
৩৬। সবরকমের সংখ্যাগুরু সামাজিক উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জনজাতি ও দলিত সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পরবে শিশুদের স্কুল ছুটির দিনসংখ্যার সমতা বজায় রাখতে হবে।
৩৭। স্কুলস্তর থেকে যে কোন বড় পরীক্ষায় শুধু ক্রমিক নম্বরের প্রচলন শুরু করতে হবে।
৩৮। প্রাথমিক স্তর থেকে জীবনশৈলী সংক্রান্ত বিষয় পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
রাজনৈতিক পরিবেশ ও অধিকার
৩৯। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবং তার আগে থেকে নাগরিকত্ব বিধি সংক্রান্ত বিষয়ে যে রাজনৈতিক অশান্তি তৈরি হয়েছে, অবিলম্বে সেই অশান্তি দূর করতে হবে।
৪০। শিশুর সচেতন সম্মতি ছাড়া তাকে নির্বাচনী প্রচারের জন্য বা অন্য কোন রাজনৈতিক মিটিং মিছিল-এ সামিল করা চলবে না।
শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিশুদের জন্য
৪১৷ স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে।
৪২৷ সব শিশুদের জন্য খাদ্যসুরক্ষা, গুণগত মানের পুষ্টি, বাসযোগ্য ঘর, চিকিৎসার সুযোগ, খেলাধুলো ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের সুযোগ, অংশগ্রহণের-মত প্রকাশের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
৪৩৷ শিশুদের সমস্ত রকম শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন এবং অবহেলা থেকে রক্ষা করতে সুনির্দিষ্ট নীতি ঘোষণা এবং তার রূপায়ণ কার্যকর করতে হবে।
৪৪। শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে সেই শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
৪৫। পথ-শিশুদের, গৃহহীন শিশুদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনী অর্থ যথেষ্ট পরিমাণে বরাদ্দ করা আবশ্যিক।
শিশু অধিকারের দাবীসনদটি নিয়ে আপনার যদি কোন মতামত/পরামর্শ থাকে, তাহলে এখানে লিখতে পারেন। https://forms.gle/XqDAAcLZen87qM1g6