জনজাতি সমাজের দাবীসনদ, কথোপকথনে গৃহীত প্রস্তাবগুলির চূড়ান্ত খসড়া
নাগরিক অধিকার
১। দেশান্তরিত হওয়ার সামাজিক স্মৃতি এবং যৌথ সামাজিক জীবনের সঙ্গে জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ধারণার পার্থক্য নিয়ে জনজাতি-র বেশিরভাগ অংশই NRC-NPR-CAA প্রক্রিয়া নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। সামাজিক কারণেই নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় তাঁদের ওপর চাপালে, জনজাতি সমাজের মানুষের বিপন্নতা বাড়বে। নবনির্বাচিত সরকারকে, পশ্চিমবঙ্গে NRC-CAA-NPR প্রক্রিয়া বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
সংরক্ষণের অধিকার
২। জনজাতি সমাজের জন্য সংরক্ষিত আসনে উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ার দায় জনজাতি সমাজের নয়, সরকারের। সরকারি পদে, নট ফাউন্ড স্যুটেবল-এর অজুহাতে, সংরক্ষিত আসন সাধারণ ক্যাটাগরিতে চালান করা চলবে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রার্থীদের নির্দ্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তার জন্য যোগ্য করে তোলার জন্য রাজ্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
৩। জনজাতি সমাজের সদস্যদের সুযোগ নিশ্চিত করতে জনজাতি সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে মনিটরিং কমিটি তৈরি করতে হবে।
৪। জনজাতি সমাজের প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়টিতে জনজাতি সমাজের আধিকারিকদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৫। সংরক্ষণ যে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের অনুগ্রহ নয় বরং জনজাতি সমাজের অধিকার এই বিষয়টা বোঝার মতন করে প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম থেকে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
৬। জনজাতি সমাজের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে
৭। জনজাতিগুলির ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের সম্যক ধারণা তৈরি করার জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই পাঠক্রমে জনজাতি সংস্কৃতির সম্পর্কে পরিচয় ঘটাতে হবে।
৮। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাতে জনজাতিগুলিকে উচ্ছেদ করে শিল্প প্রকল্পের পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে। জনজাতিগুলির থেকে যে সমস্ত পরিবার উন্নয়ন উদ্বাস্তু হয়েছেন তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করতে হবে।
৯। জনজাতি সমাজের সংস্কৃতিকে বিকৃত ও ভুলভাবে প্রদর্শন করার প্রবণতা বন্ধ করতে জনজাতি সমাজের সংস্কৃতি সম্পর্কে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সচেতনতা বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
১০। ট্যুরিজম-এর নামে জনজাতি সমাজের সংস্কৃতি ও মহিলাদের পণ্যায়ন বন্ধ করতে হবে।
জীবন ও জীবিকার অধিকার
১১। স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে রোজগার বাড়ানোর জন্য জনজাতি সমাজের মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
১২। ব্যবসার জন্য স্থানীয় মান্ডিতে জনজাতি সমাজের সদস্যদের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে।
১৩। জনজাতি সমাজের সদস্যদের জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
১৪। দুই বছর সময়কাল বেঁধে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র জনজাতি সমাজকে সাক্ষর করে তোলার জন্য সাক্ষরতা অভিযান করতে হবে, এবং দুই বছরের মধ্যে জনজাতি সমাজের সকল সদস্যদের সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৫। জনজাতি সমাজের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এবং জনজাতি সমাজের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে পাঠক্রম ঠিক করতে হবে।
১৬। জনজাতি সমাজের সদস্যদের জন্য বাংলা ও ইংরিজি ভাষাশিক্ষার সুযোগের বন্দোবস্ত করতে হবে।
১৭। ICDS কেন্দ্রগুলো ৩৬৫ দিন খোলা রাখতে হবে। খাবারের গুণমান ঠিক করতে হবে।
১৮। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে জনজাতি সমাজের সদস্যদের থেকে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
১৯। জনজাতি সমাজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুলে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে সপ্তাহে দু ঘন্টা করে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
২০। মাধ্যমিক স্তরে জনজাতি সমাজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
২১। জনজাতি সমাজ সহ সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য প্রাথমিক স্তরে মেধাবৃত্তি চালু করতে হবে।
২২। জনজাতি সমাজ সহ সমস্ত ছাত্র ছাত্রীর জন্য দশম শ্রেণী অবধি মিড ডে মিল চালু করতে হবে।
২৩। জনজাতি সমাজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্কলারশিপ অর্থের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
২৪। জনজাতি অধ্যূষিত জেলাগুলোতে জনজাতি সমাজের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
২৫। জনজাতি সমাজের সদস্যদের জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষালাভের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
২৬। জনজাতি সমাজের যুব সম্প্রদায়ের জন্য পশুপালন প্রভৃতি প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করতে হবে। যথেষ্ট সংখ্যায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
২৭। স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে রোজগার বাড়ানোর জন্য জনজাতি সমাজের সদস্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২৮। জনজাতি সমাজের সদস্যদের উন্নতমানের ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষি প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
২৯। জনজাতি সমাজের মধ্যে ভেষজ এবং তার ওষধিগুণ সম্পর্কে যে পরম্পরাগত জ্ঞান তা বহু কঠিন অসুখের নিরাময় ঘটাতে সক্ষম । এ বিষয়ে সরকারী সাহায্য ও উৎসাহ বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্যের অধিকার
৩০। এক বছরের মধ্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে জনজাতি সমাজের মহিলাদের মধ্য থেকে জনজাতি অধ্যূষিত এলাকায় গ্রামভিত্তিক স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
জনজাতি সমাজের নারীদের দাবী
৩১। অবিলম্বে আইন করে ডাইনি প্রথা বন্ধ করতে হবে।
৩২। জনজাতি সমাজের মহিলা মজুরি শ্রমিকদের পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে হবে।
৩৩। জনজাতি সমাজের অভিবাসী মহিলা শ্রমিকদের শিশুদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।
৩৪। জনজাতি সমাজের অভিবাসী মহিলা শ্রমিকদের জন্য শৌচালয়ের বন্দোবস্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩৫। জনজাতি সমাজের কাঠামো অনুযায়ী, পরিবারের বড় মেয়েদের গৃহস্থালীর কাজে অংশ নিতে হয়। তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩৬। জনজাতি সমাজের নারীদের বিরুদ্ধে যৌন ও অন্য যে কোন হেনস্থার ঘটনায় প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। অভিযোগ জানানো মাত্র উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩৭। জনজাতি সমাজের মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে মহিলাদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় আবাসিক বিদ্যালয় তৈরি করতে হবে।
৩৮। জনজাতি সমাজের মহিলাদের ঠকিয়ে তাদের জমি জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে জনজাতি সমাজের মহিলাদের জমি বেআইনিভাবে দখল করার যে কোন চেষ্টা রুখতে হবে।
৩৯। বিভিন্ন রকম হস্তশিল্পে জনজাতি নারী সমাজ পরম্পরাগত জ্ঞানে ও দক্ষতার উত্তরাধিকার বহন করেন। সরকারীভাবে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে এবং উপযুক্ত বাণিজ্যিক পরিকাঠামো তৈরি করে তাঁদের আর্থিক উন্নতি ঘটানোর প্রকল্প প্রণয়ন করতে হবে।
জনজাতি সমাজের প্রতিনিধিত্ব ও স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার
৪০। গ্রাম স্তর থেকে রাজ্য স্তর পর্যন্ত জনজাতি উন্নয়ন বোর্ড জনজাতিদের দ্বারাই নির্বাচিত করার ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে।
৪১। জঙ্গল সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এবং দায়িত্ব জনজাতি সমাজের হাতে ছাড়তে হবে।
৪২। মাঝি পারানিক পর্ষদ বোর্ড একটি সংবিধান স্বীকৃত সংস্থা স্থাপন করতে হবে।
৪৩। জনজাতি সমাজের জন্য যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়ণে জনজাতি সমাজের অংশগ্রহণ ও অনুমোদনকে নিশ্চিত করতে হবে।
৪৪। মাঝি পারনিক জমি-কে পুনরুদ্ধার করে জনজাতি সমাজের স্বনির্ভর গ্রামের ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪৫। রাজ্য বাজেটের ১০ শতাংশ জনজাতি সমাজের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করতে হবে।
অরণ্য, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার
৪৬। প্রত্যেক গ্রামে জাহেরথান-কে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কেন্দ্র-র স্বীকৃতি দিতে হবে।
৪৭। জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট-এর অধীনে অরণ্যসম্পদ বিক্রীর থেকে পাওয়া লাভের পুরোটাই সংশ্লিষ্ট জনজাতি সমাজের গ্রামের অধিবাসীদের দিতে হবে।
৪৮। অরণ্যের গাছ কাটার সময় নতুন করে শাল, পিয়াল প্রভৃতি গাছের চারা রোপণ করতে হবে। ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি প্রভৃতি গাছের চারা রোপণ করা বন্ধ করতে হবে।
জনজাতি সমাজের দাবীসনদটি নিয়ে আপনার যদি কোন মতামত/পরামর্শ থাকে, তাহলে এখানে লিখতে পারেন। https://forms.gle/XqDAAcLZen87qM1g6