কলকাতা কমন্স

ক্যালিকো হুড। ছবি সূত্র - উইকিমিডিয়া কমন্স, মেলবোর্ন।ক্যালিকো হুড। ছবি সূত্র - উইকিমিডিয়া কমন্স, মেলবোর্ন।

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া, ১৮৫৭

-- খুব কাঁদছে যে।
-- তা কাঁদুক না, তোমার কী হে? নিজের কাজ করো।
-- খিদে পেয়েছে বোধহয়।
-- তো আমি কী করবো, নাচবো?
-- তুমি একটু দাঁড়াও না, খাবার নিয়ে আসি।
-- কোত্থেকে আনবে শুনি? প্যানট্রি তো বন্ধ, ছ'টার আগে খুলবেই না।
-- তোমার টিফিন নেই?
-- আছে। আলবাত আছে। শত শতাংশ আছে। বউ বানিয়ে দিয়েছে, ট্যাঁকেই আছে।
-- একটু দাও না, বেচারা শান্তি পাক।
-- থাক, আর "বেচারার" শান্তি পাইয়ে কাজ নেই। নিজের চড়কায় তেল দাও।
-- আহা, ওর কান্না থামছে না। রাতে কিছু খায় নি?
-- কী জানি, রাসেলের ডিউটি ছিল মাঝরাত অবধি, তারই তো খাবার দেওয়ার কথা।
-- একটু দাও না তোমার টিফিন, একটু রুটি...
-- ওহে, আমার টিফিনের দিকে নজর না। ট্যাঁকে যা আছে তাই দিয়েই সারারাত কাটাতে হবে। গাভনার সায়েব বেশি কিছু আনতে দেন না ভিতরে, তুমি নতুন এসেছো বুঝবে না। এই ট্যাঁকে যা আঁটবে ততটাই আনা যাবে।
-- এরকম নিয়ম কেন?
-- বছর দুয়েক আগে ছিল একজন, আমাদেরই মতো 'বি' ব্লকে ডিউটি পড়তো তার। নাম ও'হেনরি, আইরিশ, ঠাকুর্দা বেলফাস্টের নামকরা গুন্ডা ছিল। তার নাকি একজনের উপর মায়া পড়ে গিছলো, তাকে নিজের টিফিন থেকে খাওয়াতো। বন্ধুত্ব বেড়ে চলাতে একদিন সে একটি ছোট ফাইল দেয় তাকে, খাবারের সঙ্গে। সেই দিয়েই...
-- তার পরেই গভার্নার সাহেব...?
-- হ্যাঁ। তখন থেকেই এই নিয়ম। সুতরাং এসব নিয়ে আর ভেবো না, কানে তুলো এঁটে রাউন্ড দাও, আর তো মাত্র পাঁচ ঘন্টা, শেষ হয়ে এলো বলে।
-- কিন্তু এত ছোট ছেলে...?
-- তাতে তোমার কী হে? এত মায়াদয়া থাকলে আমাদের লাইনে আসতে গেলে কেন? সেই ও'হেনরির ছিল মায়াদয়া, শেষে তার "বন্ধু" তার গলাটা কুচুত করে কেটে...
-- না না, বলার দরকার নেই, শুনলে কেমন গা গুলোয়। কিন্তু কান্নাটা তো আর সহ্য করতে পারছি না।
-- তাহলে তোমার টিফিন থেকে দাও না হে, আমারটা নিয়ে টানাটানি কেন?
-- আমার টিফিন? সেটা তো...
-- কী হলো? ফেলে এসেছো নাকি?
-- না, তা নয়।
-- তাহলে আর কী? এত ভাবাভাবি কী আছে? দিয়ে দাও, এতই মায়াদয়া যখন।
-- না কিন্তু তুমি বললে না গভার্নার সাহেবের বারণ...
-- ও বাবা, এই তোমার বুক ফেটে যাচ্ছিল ত্যাঁদড়টার কান্না শুনে, এর মধ্যে সাহসের বেলুন ফুস?
-- তাও? নতুন চাকরি, যদি উল্টো-পাল্টা রিপোর্ট যায়...
-- অ, বুঝেছি। তোমার সন্দেহ...ভয়, যে আমি বলে দেবো? নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাও, আমার কাজ বি-ব্লকের বন্দীদের পাহারা দেওয়া, অন্য পাহারাদারদের নয়। যাও যাও, দেরী করো না। বেশিক্ষণ এইভাবে চ্যাঁ-ম্যা করলে ব্রডেরিক সায়েবের কানে যাবে, আর তারপর আমার-তোমার রোস্ট, আর ছেলেটার পিঠের চামড়ার ডুগডুগি।

ঘটাং ঘটাং। লোহার দরজায় লোহার চাবি ঘোরানোর শব্দ, লোহার মশালের আগায় সোনালি আগুনের অস্থির আলো ডুকরে ওঠে কি? ভয়-মেশানো ফোঁপানো গলা দিয়ে আর রা কাড়ে না, জলের কুঁজোটা শুকিয়ে গেছে। ওল্ড মেলবোর্ন জেলের বি-ব্লকে সদ্য চাকরি পাওয়া পাহারাদার ব্রুক এভান্সের ট্যাঁক থেকে বের করা রুটির টুকরো তার হাতেই রয়ে যায়, অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরোয় তার গলা দিয়ে।

-- কী হল হে?
-- দেখে যাও, এসে দেখে যাও। বর্বর বর্বর...
-- বর্বর? কে বর্বর? ছেলেটা?
-- দেখে যাও।
-- কী দেখবো…? মাতা মেরীর দিব্যি!
-- বর্বর! এরা বর্বর! তোমার ছুরিটা দাও, এক্ষুণি খুলে দি। ছি ছি ছি, পাঁচ বছরের ছেলেকে আটকে রেখেছে, তার উপর এই?
-- দাঁড়াও হে, অত হুড়োতাড়া করো না।
-- করবো না মানে? এই বর্বরতা মেনে নেবো?
-- মানা না মানার তুমি কে হে? নিয়ম তো করবেন গাভনার সায়েব। তিনি যদি বলেন তিন বছরের শিশুরও ক্যালিকো হুড লাগবে, তাহলে লাগবে।

********************************************************************************************

ক্যালিকাট, অধুনা কোঝিকোড, থেকেই ক্যালিকো কথাটির উৎপত্তি। সেখানকার সূতা-কারিগরদের হাতে তৈরি ক্যালিকো যে কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন জেলে পৌঁছয়, তার ইতিহাস আলাদা। ক্যালিকাটের সূক্ষ্ণ ক্যালিকো হয়ে ওঠে মেলবোর্ন কারাগারের কর্কশ হুড। এই ক্যালিকো হুড পরানো হত বিপজ্জনক আসামীদের, সলিটারি কনফাইন্মেন্ট যাদের বরাদ্দ, বাদবাকি আসামীদের সঙ্গে যাতে তারা কথা না বলতে পারে। ১৮৫৭ সালে তিন বছরের মাইকেল ক্রিমিন্সকে এই জেলে আটক করা হয়, ছাড়া হয় ছ’মাস বাদে। তার অপরাধ? সে কথা শুনত না, এবং কান্নাকাটি করে গোল বাঁধাত। ছোট্ট মাইকেলকে ক্যালিকো হুড পরানো হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না, কিন্তু ভারতীয় কারিগরদের অপরূপ সৃষ্টি সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় বুকে যে এক কদাকার রূপ নিয়েছিল তা নিয়ে দ্বিমত নেই।

এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।

তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।

যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।

আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।