মারী আঁতোয়ানেতের পোর্ট্রেট, “মসলিনে মারী”। শিল্পী - এলিসাবেথ-লুই ভিঝে লে ব্রাঁ ওরফে মাদাম লেব্রাঁ
প্যারিস, ফ্রান্স, ১৭৮৩
আর পারছি না।
ঘুম আসে না আর। এপাশ-ওপাশ, এপাশ-ওপাশ করে শেষে ওনার ঘুমটাই না ভাঙিয়ে দি। ওনার জন্যও তো দারুণ দিন কালকে। আগে করেছেন যদিও। জঁ-বাপতীস্ত-পিয়ের লে ব্রাঁ জন্য প্যারিস সালঁ কোন নতুন জিনিস নয়। যার আপন ঠাকুর্দা রাজা চতুর্দশ লুইয়ের জমানায় ফরাসী অকাদেমীর অধিকর্তা ছিলেন, যে ছোটবেলা থেকে ঠাকুর্দার সঙ্গে সালঁ ঘুরেছে, রাজপরিবারের সঙ্গে যার আলাপ বহু বছরের, তার কাছে এসব মামুলি ব্যাপার।
কিন্তু আমার কাছে তো নয়।
প্যারী সালঁ! বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্ট এগজিবিশন। আর তাতে উঠতে চলেছে আমার আঁকা ছবি। এই প্রথম। আমি, মঁসিয়ো ভের্নের ছাত্রী এলিসাবেথ-লুই ভিঝে লে ব্রাঁ। আর এ ছবি তো যে-সে ছবি নয়। খোদ রানীর ছবি। হার মোস্ট ক্রিশ্চিয়ান ম্যাজেস্টি মারী আঁতোয়ানেত, ফ্রান্স আর নাভারের রানীর পোর্ট্রেট।
ছবিটার নাম কী দেবো তা নিয়ে বহু দিন দোনামোনা করছিলাম। লা রেন টেনঁ উন রোজ? গোলাপ হাতে রানী? নাকি লা রেন দঁ ল জারদঁ? পোর্ট্রেটটা তো পেতি ত্রিয়াননের বাগানে বসেই করা। শেষে এর ফয়সালা করলেন রানী নিজেই।
রানীর চিঠি এসেছিল হঠাতই। আমি প্যারীতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি, নাম ছড়াচ্ছে। রাজপরিবারেও যে আমার কথা পৌঁছে গেছে ভাবতে পারি নি। একদিন সকালে হাতে পেতে স্যাটিন ফিতে খুলে দেখি অপরূপ হাতের লেখা, নিজেই লিখেছেন।
মাদাম লেব্রাঁ,
আপনার পোট্রেট আঁকার ক্ষমতার কথা আমি শুনেছি মসিয়োঁ ভেরনের কাছে। ফরাসী সমাজে একজন মহিলা নিজ ক্ষমতাবলে নিজ কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন শুনে আমি গর্বিত। আপনি যদি আমার একটা পোট্রেট আঁকতে সন্মত হন, তাহলে আমি খুশি হব।
ইতি,
মারী অফ ফ্রান্স
সম্মত না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পত্রপাঠ উত্তর পাঠালাম, এবং পরের দিন উপস্থিত হলাম ভার্সাইতে। প্রথম দর্শনে ভীষণ ভয়ে-ভয়ে ছিলাম, কিন্তু রানীর সুন্দর ব্যবহার দেখে এবং কথাবার্তা শুনে মনে বল বুকে সাহস দুটোই পেলাম। কথা হল যে সকালবেলা করে সপ্তাহে তিন বার সিটিং হবে। ভার্সাইয়ের ভিতরে অবস্থিত রানীর পছন্দের শাতো পেতি ত্রিয়াননের বাগানে বসেই ছবিটি আঁকা হবে বলে ঠিক হল। অবশ্যই রোকোকো কায়দায়, বারোকের অনমনীয় কাঠিন্যের বাঁধুনির মধ্যে মারী আঁতোয়ানেতকে আটক করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। শেষে প্রশ্ন উঠলো রানীর পোষাক নিয়ে। অস্ট্রিয়ার ভূতপূর্ব আর্চডাচেস এবং ফ্রান্সের বর্তমান মহারানী কী পরে পোর্ট্রেট আঁকাবেন? এমন পোর্ট্রেট যা সালঁ দেখানো হবে? নিয়ম অনুযায়ী রানীর ভারী লাল রঙের ভেলভেটের গাউন পরারই কথা। কিন্তু রানী আর আমি পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে না, প্রচলিত রীতি মানা হবে না, এই পোর্ট্রেট হবে একটু আলাদা ধরনের। রানী যে শুধুই কর্তব্যপরায়ণতা বা রীতিনীতির গন্ডিতে আবদ্ধ থাকেন তা নয়, তাঁর নিজস্ব একটি জীবন রয়েছে, রাজকীয় শিষ্টাচার ছাড়াও যে তিনি এক স্বাধীনচেতা মানুষ, এই ছবিতে তাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। তাই ছবিটি ভার্সাইয়ের গম্ভীর হল অফ মিরার্সে না করে করা হবে পেতি ত্রিয়াননের উৎফুল্ল বাগীচায়। রানীর হাতে থাকবে একটি গোলাপ, পাশে থাকবে গোলাপের ঝাড়। রানীর মাথায় থাকবে রিবন লাগানো স্ট্র হ্যাট, তাতে পালকের কারুকার্য। আর পরনে থাকবে কোমরে গজের স্যাশ দিয়ে আটকানো মসলিনের গাউন।
মসলিন! এই মসলিনই যে এত গোল পাকাবে কে জানতো।
ছবির নামটা রানীই ঠিক করেছিলেন। বলেছিলেন, এই মসলিন আসে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে, নিপুণ কারিগরদের হাতে বোনা এই কাপড়ের কোন দোসর নেই। প্রাচীন রোমে এক আউন্স মসলিন কিনতে লাগতো এক আউন্স সোনার মুদ্রা। তাই ছবির নাম থাক “মারী দঁ উন রোব দে মুসলিন” বা “মসলিন পোশাকে মারী আঁতোয়ানেত”। ছোট্ট করে “মসলিনে মারী”। মসলিনের পোশাক রানীর সবচেয়ে প্রিয়, তাই ছবির নাম নিয়েও কোন দ্বিমত ছিল না।
কিন্তু গোঁড়া শিষ্টাচার আর রক্ষণশীলতার সঙ্গে যুঝবে এ ক্ষমতা ফ্রান্সের রানীরও নেই। গত সপ্তাহে আমার ছবির উদ্বোধন হয়েছে প্যারীর সালঁতে। আমার এই সাতাশ বছরের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। ছবিটিও প্রথমে খুব বাহবা পেয়েছিল। আনন্দে গর্বে বুক ভরে গিছলো, রানী এবং রাজা দুজনেই খুব প্রশংসা করেছিলেন ছবিটির, যদিও রাজার পেন্টিঙের প্রতি বিশেষ কৌতুহল বা জ্ঞান আছে তা নয়। একথা উনি স্বয়ং বলেছেন আমায়। রাজারানী চলে যাওযার পরেই লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো যে এই ছবি ঠিক নয়, এভাবে “শেমিজ” পরে রানীর ছবি আঁকানো উচিত হয়নি, ফ্রান্সের রানী কেন শেমিজ পরে লোকসমক্ষে আসবেন, লাজলজ্জারীতিনীতিশিষ্টজ্ঞানের শ্রাদ্ধ, এইজন্যই জাতির আজ এত দুর্দিন, ফসল ফলেনি, খাবারের দাম আকাশছোঁয়া, আর রানী নাকি শেমিজ পরে...ছিঃ।
যাকগে। মানুষের মানসিকতা যে এত তাড়াতাড়ি বদলাবে না তা আমি জানি। বোধ করি রানীও জানেন। জেনেশুনেও উনি বিব্রত নন, আমাকে কমিশন দিয়েছে আরো তিনটে পোর্ট্রেটের, সবই একই ধরনের পোজ, একই অভিব্যক্তি। মনে হয় নিজের জনপ্রিয়তার প্রতি ওনার ভরসা আছে। তা যে কমবে না সে বিষয়ে উনি নিশ্চিত। আমি অতটা নই। আমি একটু ভয় পেয়েছি। লোকের মন বদলাতে কতক্ষণ। একক মানুষ ভেবেচিন্তে যত মত তত পথ মেনে চলে বা চলার চেষ্টা করে, একপাল মানুষ অত বেশি ভাবে না। কাল সকালে ভার্সাইতে যেতে হবে, মনে একটা অজানা আশঙ্কা তৈরী হচ্ছে, “মসলিনে মারী”ই না মারীর জীবনে অন্ধকার নিয়ে আসে।
********************************************************************************************
খানিকটা এনেছিল বটে। ১৭৮৩ সাল, রাজা ষোড়শ লুইয়ের ফ্রান্সে তখন খাদ্যাভাব চলছে, অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয়। এরই মধ্যে রাজপরিবার, বিশেষত ভূতপূর্ব অস্ট্রীয় আর্চডাচেস এবং তৎকালীন ফ্রান্সের রানী মারী আঁতোয়ানেত যে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন তাতে ফ্রান্সের জনগণের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ঘটনাপরম্পরায় যা শেষমেষ ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল কারাগারের উপর আক্রমণের চেহারা নেয়। “রুটি না থাকলে কেক খাক না”, এই কথা মারী আঁতোয়ানেত বলেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু গিলোটিনে ওনাকে চড়তে হয় ১৬ অক্টোবর ১৭৯৩ সালে।
এলিসাবেথ-লুই ভিঝে লে ব্রাঁ ওরফে মাদাম লেব্রাঁ ছিলেন তখনকার ফরাসী চিত্রশিল্পের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিখ্যাত ফরাসী পেন্টার ক্লদ-জোসেফ ভেরনের ছাত্রী ছিলেন, রোকোকো স্টাইলে প্রধানত আঁকতেন পোর্ট্রেট, মারী আঁতোয়ানেতের বেশ কিছু পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন, যার মধ্যে “মসলিনে মারী” অন্যতম বিখ্যাত।