সপ্তগ্রাম, ১৫৬২
বেআক্কেলে ছুঁচটা বুড়ো আঙুলের ডগাতেই ফের পুট করে ফুটে গেল। টুকটুকে লাল রেশমের পদ্মটাকে অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রক্তের ফোঁটাটা চট করে শুষে নিল সাজু। গোয়ালঘরের এই কোণটাতে এমনিই আলোর টানাটানি, তায় মশার অত্যাচারে একঠায়ে বসে থাকা দায়। এদিকে পদ্মের পাপড়ি বাকি এখনও এককুড়ি। চারধারের কল্কা, সেই নমুনা বানাতে যা করেছিল তাই রয়ে গিয়েছে, আর যে নকশাটা কোণজুড়ে পড়বে সেটা তোলা হয়নি একফোঁড়ও। ভেবেই ঘেমে ওঠে সাজু।
বাঁকা মিঞা টেনে হিঁচড়ে ঝুরোমাটি সরিয়ে শেষমেষ তুলেই আনল শেকড়ফলের মস্ত গোছাটা। থোলোথোলো মেটে রাঙা ফলগুলো যেন আলো করেছিল ভিজে মাটির কোল। তামাটে গোঁফে খাস নবাবি মেজাজে চাড়া দিতে দিতে যে হাসিটা হেসে উঠল ডিমেলো সায়েব তাতেই সাফ মালুম বাঁকা মিঞার মেহনত ঠিক ঠিক মাটিতেই মিশেছে। বাঁকার পিঠে জবরদস্ত থাবড়ায় তারিফ বসিয়ে দিলেন ডিমেলো সায়েব।
প্রায় বছরখানেক হল, এ গ্রামে প্রায় বন্দী হয়ে আছে ফ্রান্সিস ডিমেলো। শঙ্কর মাছের কাঁটাটা যেমন বিষিয়ে উঠেছিল, হাঁটু থেকে পা টা তো বাদ যেতই, সঙ্গে ডিমেলোর প্রাণটিও জরিমানা বাবদ বাদ পড়ত। শেষে এই আধান্যাংটা লোকগুলো কিসব ওষুধ বিষুধ তুকতাক করল, সবজেটে হতে বসা ঠ্যাংশুদ্ধ প্রাণে বেঁচে গেল ডিমেলো। মজার দেশ এটা। অতি উত্তম বন্দরও বটে। সাতগাঁও নামটা তার দেশোয়ালি ভাইদের জিভে ফুটবে না, তাই নিজে থেকেই একটা জম্পেশ নাম দিয়ে জেনারেল আফোনসোকে পাঠিয়েছে ডিমেলো - পোর্তো পেকুইনো।
- তোমার দেশ কতদূরে সায়েব?
দুটো সদ্য তোলা আলু পুড়িয়ে নুন ঘি দিয়ে মেখে এনেছিল সাজু।
- নদী পেরিয়ে সমুন্দর, তারও পরে।
মস্ত দীর্ঘশ্বাসে নোলকটা কেঁপে ওঠে সাজুর। তদ্দিনে তার বিয়েই হয়ে যাবে।
- ফের কবে আসবে?
- আসবে।
এখানকার মাটি বেজায় মিষ্টি। কেমন হয় যদি এখানে আলু ফলিয়ে চালান করা যায় আফ্রিকায়? ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগালে?
- তোমার আঙুলে ওসব কি দাগ সাজু?
ডুরে পাড়টার তলায় চট করে হাতটা লুকিয়ে ফেলল সাজু।
ওটা ছুঁচের দাগ। জানে ডিমেলো। এই আরেক তাজ্জব ব্যাপার করে এরা। পুরোন কাপড়ের পাড় থেকে সুতো খুলে পুরোনো কাপড় জুড়ে নকশা তোলে। ছুঁচ তো নয়, যেন তুলি। সাজুর মত বাচ্চা মেয়েরাও করে নাকি ওসব? কে জানে, বাঁকা মিঞার বেটি তো, সবেতেই সকলের চেয়ে এগিয়ে।
গোটা সাতগাঁও সেদিন ভেঙে পড়ল হুগলীর পাড়ে। ফিরিঙ্গি জাহাজ তার কাপ্তানসমেত মেরামত হয়ে জলে ভাসতে তৈরী। মামুদ শা’ খাস তোফা পাঠিয়েছেন জমকালো কিংখাবে মুড়ে। এদিকে জাহাজের খোল ঠাসা গাঁয়ের মানুষের হাতে গড়া উপহারে। কি নেই সেখানে। পিঠেপুলি, আচার, নারকেল, ডাব, সুপুরি, কাপড় থেকে শুরু করে আঁটি বাঁধা পাট, পুঁটলি করা তুলো মায় গয়নাবড়ি।
আজ আর কাজল পরে নি সাজু। জানে চোখে পানি আসবেই, খামোখা কাজল ধেবড়ে একাকার হবে। কিন্তু কি ভিড় বাবা, আদৌ আর সায়েবকে দেখতে পাবে কিনা এই উৎকণ্ঠার চোটে চোখে পানি আসার ফুরসতই পেল না। ঠেলেঠুলে এগোতে পারে নাকি ? এদিকে বগলে গোটানো তার সাত রাজার ধন। ঘাম লাগলে তো সর্বনাশ। আহা, সায়েব যদি একবার দেখত, মাদারজলার খাঁড়ি যেমন পার করে দিয়েছিল তেমন করে ছোঁ মেরে কাঁধে তুলে ঠিক এগিয়ে যেত। ধুত।
- এই সাজু, ইদিক পানে। শিগগির করে আয় দিকিনি মা?
বাপের গলা শুনে দুনো বল নিয়ে ভিড় ঠেলতে থাকে সাজু। এর ওর পায়ের ফাঁক গলে যখন পৌঁছাল জাহাজ তখন ছাড়ো ছাড়ো। ঐ টকটকে পিরানে সায়েব হাত নাড়ছে।
সাজু! আ দেসপেদিদা! আতে মাইস!
সসংকোচে আঁচলের তলা থেকে বার করে জিনিষটা সায়েবের দিকে বাড়িয়ে ধরল সাজু। বাঁকার চক্ষুস্থির। কাঁচা হলুদ রংটা বড়ো চেনা লাগে যেন! আর সুতোর জৌলুষও! মুখপুড়ি বিয়ের শাড়িখানার এই দশা করেছে শেষ পর্যন্ত!
ডিমেলোর মুখে ফুটে ওঠে চওড়া হাসি।
- মুয়িতো ওব্রিগাদো, সেনোরা।
আঁতুড় থেকে সদ্য বেরনো সাজুকে খবরটা দিল বাঁকা মিঞাই। সেই নীলচোখো সায়েবদের জাহাজ ফের ঘাটে ভিড়েছে। পাক্কা তিন বছর পরে। তারা যে খরিদারি করবে, তাতে গাঁয়ের মধ্যে বেদম হুড়োহুড়ি লাগবে এ তো জানা কথা। কিন্তু তা বলে এক হাজার নকশী কাঁথার বায়না করবে এ খোয়াব কে দেখেছিল! নমুনাটা চিনতে ভুল হয় নি বাঁকার। উড়তে উড়তে খবরটা মেয়েকে দিতে এসেছে আগে।
রহমত, মোতি, রঘু, বিশ্বম্ভরের সাথে কথা কয়ে নিয়েচি রে বেটি! ওরাই ফোঁড় তুলবে, তুই খালি নকশা বলে দিবি। সুতো, কাপড় সব আমি দেব। দাদনে। কেমন বুঝচিস বল। নাতিন আমার সোনার বরাত নিয়ে এলেন গো।
নমুনাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সাজু। পাকা ব্যবসায়ী গোটা কাঁথাটা পাঠায়নি, কোণ থেকে কেটে বার করে এনেছে এক ফালি, যেদিকে এখনও দিব্যি জ্বলজ্বল করছে তার মস্ত ফিরিঙ্গি নামের আধখানা।
নকশী কাঁথা
এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।
তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।
যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।
আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।
আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।