এই লেখাটা তৈরি হয়েছিল, ২০১৯-এর মে মাসের লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে। ২০২০-র অগাস্ট-এ আত্মনির্ভর ভারত তৈরির কথা হচ্ছে। এবং সেই লক্ষ্যে একটা ছিমছাম সরকার গড়ার চেষ্টায়, বাড়িত মেদ বিবেচনায়, হ্যান্ডলুম বোর্ড-এর মতন উপদেষ্টা সংস্থাগুলোকে তুলে দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-এ এই লেখাটায় এরকম বেশ কিছু প্রচ্ছন্ন আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তাই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, ২০২০-তে আবার সেটাকে ফিরে দেখা।
আপনার বাড়ি কোথায়? যে কোন জায়গায়, স্বদেশে, বিদেশে, পার্টিতে, ধাবায়, পণ্ডিতদের সেমিনারে, আঁতেলদের আড্ডায়, সান্ধ্য ঠেকে, চাষীর চালাঘরে, এ প্রশ্নের জবাবে টানটান বলা যায় শান্তিপুর।
ভালো ডাক্তার নেই, ভালো স্কুল নেই, আধুনিক শপিং মল নেই, কোন আধুনিক শহরের পাশে টিমটিমে এই মফস্বল শহরের নাম বলতে দ্বিধা না হওয়ার একটা কারণ এ নামকে সারা ভারত চেনে তার তাঁতে তৈরী কাপড়ের জন্য। আজ নয়, চৈতন্যের আমলেরও আগে থাকতে শান্তিপুর এই একটা কারণে বাইরের লোকের কাছে খ্যাত, হস্তচালিত তাঁত, হ্যান্ডলুম।
ও, আপনি শান্তিপুর, মানে সেই তাঁতের শাড়ির বিখ্যাত শান্তিপুর! হ্যাঁ, এ যে কতবার শুনেছি, একটু ভালোলাগাও অনুভব করেছি বৈকি! কিন্তু হাতে চালানো তাঁত নিজে বোনেন, এরকম একজন তাঁতীকে যদি কেউ বলেন, ও আপনি সেই শান্তিপুর, তার হাসি অত চওড়া হবে না, কারণ তিনি জানেন, তাঁতী মরছে, মরছে তাঁতও।
অথচ এই ভারতবর্ষকে হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবী যেকটা কারণে চেনে তার অন্যতম হল হাতের তাঁতের কাপড়, ভারতের সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক পরিচয়ের অনেকখানি জুড়ে আছে তা। চাষবাসের পরে যে সেক্টরে ভারতের সবচেয়ে বেশি মানুষ জুড়ে আছেন, তাহল এই হ্যান্ডলুম সেক্টর, নানাভাবে, সুতো তৈরী থেকে শুরু করে কাপড় বিক্রী অবধি প্রায় ৬৫ লক্ষ পরিবারের জীবন এর ওপর দাঁড়িয়ে, অথচ, শুধু শান্তিপুরে নয়, সারা ভারত জুড়ে তাঁতী মরছে, হাতের তাঁতের মৃত্যুঘন্টা বাজছে। চাষীদের আত্মহত্যা নিয়ে পরিসংখ্যান হাতের কাছেই, কিন্তু তাঁতীর খবর? গত ২০১৪-১৭ তিন বছরে অন্ধ্রে ৬১৫ জন তাঁতী, বেনারসে ২০ জন তাঁতী আত্মহত্যা করেছেন, ১৫০০ আত্মহত্যার প্রচেষ্টার খবর পাওয়া গেছে।
সেই ব্রিটিশরা এদেশের তাঁতীর আঙুল কেটে নিজেদের দেশের মিলের কাপড় ঢোকানো থেকে শুরু করে, এদেশের মসলিনকে ধ্বংস করে, শুধু তাঁতীদের ভাতে মেরেছে তাই নয়, ভারতের স্বাভিমানের যে অহঙ্কার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যে বুনিয়াদ তাকেও ধ্বংস করতে চেয়েছে।
গান্ধী খাদি পরেছেন, তার অর্থনৈতিক চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল হ্যান্ডলুম, একথা ঠিক, কিন্তু তার উত্তরসূরীরা শক্তিশালী মিলমালিকদের চাপে ক্রমশ নতিস্বীকার করেছে। ক্রমশ নীতিগুলো হেলে গেছে পাওয়ারলুম আর মিলমালিকদের পক্ষে। যুক্তি ঐ একটাই, বাজারের যুক্তি, মিল বা পাওয়ারলুমের কাপড় সস্তা, টেঁকসই, উন্নত প্রযুক্তি তো পুরনো প্রযুক্তিকে সরিয়ে দেবেই, এইসব। তারপর এসেছে সিন্থেটিক সুতো, নাইলন, টেরিলীন, পলিয়েস্টার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বদান্যতায় লাইসেন্স পেয়ে উত্থান ঘটে ধীরুভাই আম্বানির, জ্বালানি তেল আর গ্যাসের খনি থেকে তৈরী সিন্থেটিক সুতোর কাঁচামাল আমদানির লাইসেন্স। বম্বে ডাইং-কে খতম করে রিলায়েন্স-এর উত্থান।
পাশাপাশি পাওয়ারলুম আর মিলের দাপট বাড়ছিল। সারাভারত জুড়ে অনেক বিক্ষোভের পর ১৯৮৫ সালে ১১ টি জিনিস শুধু হ্যান্ডলুম থেকেই তৈরী হবে এই আইন পাশ হয়। তাঁত এবং তাঁতীদের জন্য বিভিন্ন ট্যাক্সে ছাড় দেওয়া হয়, ইন্সেন্টিভ স্কীম চালু হয়, কিন্তু পাওয়ারলুম হাতের তাঁতের তৈরী জিনিসের প্রায় হুবহু নকল তৈরী করে ঐ ছাড়, ইন্সেন্টিভের সুযোগের অনেকখানিই নিজেদের গ্রাসে নিয়ে নেয় সারা ভারত জুড়ে৷
আরেকটি আইন পাশ হয়েছিল ১৯৭৪ সালে, আইন ঠিক নয়, নোটিফিকেশন। হাতের তাঁতের সুতোর জন্য গাঁটরি বিশেষভাবে প্যাক করতে হয়। সেই সুতো রঙ করা, চরকায় নলি পাকানো, ড্রাম হাটা, এর সাথে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ এবং পরিবার জড়িয়ে ছিলেন, এখনও আছেন। ১৯৭৪ সালে এক নোটিফিকেশনে বলা হয় যে মিল যে সুতো তৈরী করবে, তার প্যাকিং-এর শতকরা ৫০ ভাগ হবে এমন যা হস্তচালিত তাঁতে কাজে লাগে, এই আদেশের নাম হ্যাঙ্ক ইয়ার্ন প্যাকিং নোটিফিকেশন ( Hank Yarn Packing Notification)। যাতে হস্তচালিত তাঁত তার উপযোগী সুতোর গাঁটরি পায়, চলতি নাম হ্যাঙ্ক ইয়ার্ন (মোড়া/লেচি)। আর কত কত কাউন্টের কত সুতো তৈরী হবে এই হ্যাঙ্ক ইয়ার্নে, তাও ঐ নোটিফিকেশনে বলে দেওয়া হয়।
সুতোকলের মালিকরা বরাবর চেয়ে এসেছে এই বাঁধন তুলে দিতে। পাওয়ারলুম আর কাপড়ের মিলমালিকদের সাথে তাদের গাঁটছড়া বাঁধা। অথচ দেশের তাঁতী, হাতের তাঁত ব্যবসায়ী, সুতোর কারবারীরা অনেকেই এই আদেশ বা নোটিফিকেশনের কথা জানেন না, তাদের জানানো হয়নি। এই নোটিফিকেশন আবার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতায় করা। তাই যদি কোন সুতোকলমালিক এই নির্দেশ না মানে, তার বিরুদ্ধে অপরাধজনিত শাস্তিও দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এই আইন থাকা সত্ত্বেও বারবার কৃত্রিম ভাবে তাঁতের সুতোর সংকট তৈরী করা হয়েছে, দাম চড়া করার জন্য, গোটা হ্যান্ডলুম সেক্টরকেই দুর্বল করে দেওয়ার জন্য।
পাশাপাশি ঐ যে ১১ টি জিনিস শুধু হ্যান্ডলুমেই তৈরী হবে, তাদের জন্য ট্যাক্স ছাড়, ইনসেনটিভ এসবের সুযোগের একটা বড় অংশ ভোগ করে গেছে পাওয়ারলুম, প্রায় অবিকল হাতের তাঁতের মতো কাপড় তৈরী করে সেগুলোকে হ্যান্ডলুম বলে চালিয়ে দিয়ে। তীব্র অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে হাতের তাঁতের কাপড়ের ব্যবসায়ীরাও মাঝেমাঝে সুতোর, রঙের, কাপড়ের মানের সাথে আপোস করেছেন, বদনাম হয়েছে এলাকার, গোটা হস্তশিল্পটারও। এদিকে সুতোয় সিন্থেটিকের মিশেল চালু হয়েছে, সে সুতো পাকাতে মাড় লাগবে না, নলি পাকানো, ড্রাম হাটা উঠে যাওয়ার জোগাড়। তাঁতী আর তাঁত দুইই আজ সংকটে। অথচ পশ্চিমবাংলায়, পাওয়ারলুমের নামে আজকাল ঘরে ঘরে যা চালু হয়েছে, তার কোন লাইসেন্সও নেই, কারণ সেই ধরনের মেশিনে কাপড় তৈরী এখনও ট্রেড বা ইন্ডাস্ট্রির তালিকায় আসেনি। আর সাধারণ হাতের তাঁতের তাঁতীর মজুরি গড়ে কাপড়পিছু ১৮০-২০০ টাকা, দিনে একটা বা সারাদিন সন্ধে নিয়ম করে খাটলে দেড়খানা কাপড়। কোথায় ন্যূনতম মজুরি, কোথায় আটঘন্টা কাজের নিয়ম।
এই বহুমুখী চাপের মধ্যে পড়া তাঁতী, তাঁতের কাপড়ের ব্যবসায়ী, তাঁতের সুতোর কারবারীদের সামনে আবারও নির্বাচন এসেছে। আগামী সোমবার, ২৯/০৫/১৯ তাঁরা ভোট দেবেন বা দেবেন না। পুরনো কাসুন্দির ঝাঁঝে কাজ না হওয়ায় অনেকেই নতুন কাসুন্দি খুঁজছেন, প্রকাশ্যে রাস্তায় ঠেকে আড্ডায় উগ্রহিন্দুয়ানার পক্ষে মতপ্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে একটা অংশকে।
ঐ যে হস্তচালিত তাঁতের সুতোর জন্য অন্তত শতকরা ৫০ ভাগ সুতো প্যাক করতে হবে হ্যাঙ্ক ইয়ার্ন (মোড়া বা লেচি) করে, এই বিধিনিষেধ ২০০৩ সালে কমিয়ে ৪০% করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সুতোকল মালিকদের সে কি উল্লাস। কে ছিল তখন সরকারে? আবারও এবছর সেই একই দলের কেন্দ্রীয় সরকার সেটাকে ৩০% করে দিয়েছে। আর সুতোকল মালিকদের সংগঠন TICI তাকে ঐতিহাসিক বলে অভিনন্দিত করেছে। মন্ত্রী স্মৃতি ইরানীর এবং সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে তারা, আর হ্যান্ডলুমের ওপর নেমে এসেছে আরও অন্ধকার। অথচ কোন রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের প্রচারে এগুলোকে আনেনি।
শুধু তাই নয়, হ্যান্ডলুম-এর জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে ২০১৬-১৭ সালে যে টাকা বরাদ্দ ছিল, ২০১৮-১৯ এ এক ধাক্কায় তার তিনভাগের একভাগ কমিয়ে দিয়েছে এই সরকার, সারা দেশজুড়ে তুমুল প্রতিবাদের পর এবছরের অস্থায়ী বাজেটে তা সামান্য বেড়েছে মাত্র। নোটবন্দীর ধাক্কার ওপর নেমেছে জিএসটির খাঁড়া। এতদিনকার ট্যাক্সছাড়ের পর এবার হ্যাঙ্ক ইয়ার্ন বা তার তৈরী কাপড়ে ৫% জিএসটি।
প্লাস্টিক নিয়ে এত হৈচৈ, কাপড়ে মেশানো প্লাস্টিক কৃত্রিম তন্তুও কিন্তু পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে।
শান্তিপুরের গোটা অর্থনীতি চাষের পাশাপাশি এখনও তাঁতের ওপর নির্ভরশীল। পেশাদার ব্যবসায়ী দেকানদার কর্মচারী কেউই পার পাবেন না, হাতের তাঁত ধ্বংস হয়ে গেলে শান্তিপুরের অর্থনীতিতে তার প্রভাবের হাত থেকে। ইতিমধ্যেই তার ফলও আমরা এখানে বুঝতে পারছি। আর যে তাঁতের শাড়ির জন্য শান্তিপুরের মানুষের মুখে পরিচিতির গর্ব ফুটে ওঠে, যে মসলিনের জন্য একদিন বাঙলার খ্যাতি হয়েছিল জগতজোড়া, সেই তাঁত কি একা হিন্দু তাঁতীরা বুনতো, হিন্দু ব্যবসাদাররা ব্যবসা করতো, বরঞ্চ পাশাপাশি হিন্দু আর মুসলমান তাঁতীর হাতের কাজেই শান্তিপুর বাঙলা ভারত তার সুনাম পেয়েছে, মুসলমান জোলা থেকেই বেড়ে উঠেছেন বারাণসীর সন্ত কবীর, যার প্রাণঢালা সহজ দোঁহায় ধরা পড়েছে তাঁতীর জীবনের শ্রমজীবী মানুষের জীবনের টানা আর পোড়েন ---
संतो खायी रहत है, चोरा लिनहि जाये
कहै कबीर विचारी के, दरगाह मिलि है आये।
সন্তো খায়ী রহত হৈ, চোরা লিনহি জায়ে
কহৈ কবীর বিচারী কে, দরগাহ মিলি হৈ আয়ে।
ভালো কাজে নিজেকে ব্যয় করলে তা থাকবে, নইলে তা চুরি হবে, কবীর বিচার করে বলে, একদিন ফল মিলবে।
ভোটটা চুরি হতে দেবেন না, মিলমালিক আর সুতোকল মালিকের বন্ধুকে নয়, হিন্দু বলে খেপিয়ে তুললেও নয়, তাতে ভোটটা চুরি যাবে, আর সবাইকেই চোর ভাবলে নোটা তো রইলোই!
শান্তিপুরের তাঁত বাঁচুক, তাঁতীরাও বাঁচুন। সে কাজ নিজেদেরই করতে হবে।
****************
পুরনো এই লেখাটার সাথে কয়েকটা কথা যোগ করতে হচ্ছে। এই লকডাউনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার গত ২৭ জুলাই, ২০২০ হ্যাণ্ডলুম বোর্ড, আর গত ৪ আগস্ট, ২০২০ হ্যাণ্ডিক্র্যাফ্ট বোর্ড তুলে দিল। এই বোর্ডগুলোর কাজ ছিল দেশে এবং বিদেশে হাতের তাঁত এবং হস্তশিল্পকে টিঁকিয়ে রাখা, প্রসারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। কেন্দ্র কী চায় এই কাজ থেকেই তা পরিষ্কার।
এই লকডাউন পর্যায়ে, হাতের তাঁত বলুন, আর আধা-পাওয়ারলুম বলুন, সবই প্রায় বন্ধ। মজুরী নেমে এসেছে অনেক নীচে। আর ব্যবসা প্রায় বন্ধ। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ। সরকার বলছে আত্মনির্ভর ভারত গড়বে। আর এদিকে ভারতের নিজস্ব বিশ্বজোড়া পরিচয়, কয়েক কোটি মানুষের ভরসার হস্তশিল্পের বোর্ডগুলোও তুলে দিচ্ছে। এই দ্বিচারিতা এবং বৃহৎ পুঁজির দালালির বিরুদ্ধে শান্তিপুর, ফুলিয়া, নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়, ধনেখালি, বিষ্ণুপুর তথা সারা বাংলার তাঁতী তথা শ্রমজীবী মানুষেরা কি প্রতিবাদ জানাবেন না?