এমন এক পোড়া সমাজে জন্মেছি যেখানে তোমার জন্মানোর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে যায় তোমার দুই পায়ের মাঝে কি আছে সেইটি। আর তার ওপর যদি ছায়া পড়ে অভাব, অনটন, অশিক্ষা, জাতপাত, চাওয়া পাওয়ার তাহলে তো কথাই নেই। এক একটা অদ্ভুত মাকড়সার জালের মতো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে জড়িয়ে বাড়তে থাকে। একটাকে ছাড়িয়ে যেতে চাইবে আরেকটা পা টেনে ধরবে। আর এভাবেই হাজারে হাজারে মানুষে বাজারে হারিয়ে যায়, আমাদের আর তাদের নামগুলো আলাদা করে মনে পড়ে না।
গত ২৯ বছর ধরে আয়নায় নিজেকে দেখেছি প্রতিদিন। আর আশে পাশে দেখেছি আরো কতগুলো মুখ, কতগুলো হারিয়ে যাওয়া নাম। সেইসব মেয়েদের কথা বলবো একটা একটা করে যাদের নাম আমাদের মনে পড়ে না।
মেয়েটার নাম মনে পড়ছে না। বয়স ১৫ মতো হবে। সামনের বছর মানে ২১ সালে দশ ক্লাসের পরীক্ষা দিতো হিসাব মতো। ওর এক দিদি, এখন বছর কুড়ির। তার বিয়ে হয়ে গেছে, দুটো বাচ্চা। ওর পরে আরো এক বোন, এক ভাই। ওর সাথে পরিচয় কাজের সূত্রে, মালদার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ঘর। বছর দেড়েক আগে যখন আলাপ হয়েছিল তখনই ও স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এতজনের পড়ার খরচ চালানো সম্ভব হয়নি ওর মা বাবার পক্ষে। ওর সবচেয়ে ছোটো ভাইটাকে দেখতে হবে কারণ মা ১০০ দিনের কাজে যায়। ঘরে ভাত করতে হবে নয়তো বাবা কাজ সেরে এসে ঘরে খাওয়ার পাবেনা। এই করোনা আর লকডাউন কালে এক পরিচিত সূত্রে খবর পেলাম ওর গত মে মাসে বিয়ে হয়ে গেছে। এই দুর্যোগের সময় অল্প বয়সের মেয়ের জন্য কম পণ দিতে হবে। এমনি সময় তো গয়না, খাট বিছানা, আলমারি, নগদ এসবের অনেক হ্যাপা তারওপর বয়স বেশী হয়ে গেলে 'ভালো পাত্র' পাওয়াও মুশকিলের। আর এই আকালের বাজারে ঘরে একটা পেট তো কমবে, বিয়ে তো আজ নয় কাল দিতে হতোই।
আমার কেবল একবার ওর মুখটা মনে পড়লো; একবার অঙ্গণওয়াড়ি সেন্টারের মেঝেতে বসে চাটাই খুঁটতে খুঁটতে বলেছিল, "যদি লেখা পড়া করে এইট পাশ করতে পারতাম, তাহলে আমিও একদিন সেন্টারের দিদি হতাম।"
গত তিন মাসে চাইল্ড লাইন কেবল মাত্র বাল্য বিবাহ সম্পর্কিত প্রায় ৬০০০ ফোন পেয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে এবং বিয়ে 'স্থগিত' রাখা গেছে মেয়ের ১৮ না হওয়া অবধি। আর এমন হয়তো আরো ৬০০০০ ফোন এসে পৌঁছাতেই পারেনি।
এই মেয়েগুলোর নাম তেমন একটা মনে পড়েনা। এদের নাম কখনো লক্ষ্মী কখনো রাবেয়া হয়ে যায়।