এমন এক পোড়া সমাজে জন্মেছি যেখানে তোমার জন্মানোর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে যায় তোমার দুই পায়ের মাঝে কি আছে সেইটি। আর তার ওপর যদি ছায়া পড়ে অভাব, অনটন, অশিক্ষা, জাতপাত, চাওয়া পাওয়ার তাহলে তো কথাই নেই। এক একটা অদ্ভুত মাকড়সার জালের মতো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে জড়িয়ে বাড়তে থাকে। একটাকে ছাড়িয়ে যেতে চাইবে আরেকটা পা টেনে ধরবে। আর এভাবেই হাজারে হাজারে মানুষে বাজারে হারিয়ে যায়, আমাদের আর তাদের নামগুলো আলাদা করে মনে পড়ে না।
গত ২৯ বছর ধরে আয়নায় নিজেকে দেখেছি প্রতিদিন। আর আশে পাশে দেখেছি আরো কতগুলো মুখ, কতগুলো হারিয়ে যাওয়া নাম। সেইসব মেয়েদের কথা বলবো একটা একটা করে যাদের নাম আমাদের মনে পড়ে না।
মেয়েটা আমাদের (আনখ সমুদ্দুর) লাবণীর ছোটো বেলার বন্ধু। আজ থেকে চার বছর আগে লাবণী লিখেছিল,
"সেই ছোটবেলা থেকে চেনা ও একসাথে পড়া এমন একজন মানুষ যে অসম্ভব শান্ত, নরম প্রকৃতির মেয়ে। ৬ অক্টোবর পঞ্চমীতে দেবীর বোধনের দিন, ছয়-সাত মাসের সন্তান রেখে মারা যায়।
শ্বশুরবাড়ি প্রভাবশালী বলে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার নামকরণ করা হয়েছে। শ্বশুর বাড়ির লোকের দাবী স্নান করার শাওয়ারে গলায় দড়ি দিয়ে নাকি সে আত্মহত্যা করেছে। মৃত্যুর পরে তার মুখ দেখে সুস্থ মানুষ বলে দিতে পারে যে এটা খুন। তবে ওর শ্বশুরবাড়ির অসুস্থ/বিকৃত মানুষের প্রভাব আর পয়সার জোরে ওর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট খুনটা কে আত্মহত্যা বানিয়ে দিতে পারার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।"
হ্যাঁ, মেরে বাথরুমের শাওয়ারে ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনাটা তারপর আত্মহত্যা বলেই স্বীকৃতি পেয়েছে। আর ওর ছোটো বাচ্চাটা এখন থাকে মেয়েটির বোনের কাছে। যাদবপুরের আরেকটি মেয়েকেও খুন হতে হয় সেই একই সপ্তাহে। কিন্তু খুন হতে হলো কেন? পণের জন্য। যতটা স্ত্রীধন আনলে একজন স্ত্রীয়ের বেঁচে থাকার অধিকার থাকে ততটা ধন মেয়েটি আনতে পারেনি বাপের বাড়ি থেকে। অথচ মেয়েটা সেই ছোট্ট বেলা থেকে স্বপ্নই দেখেছিল সে সংসার করবে। শাখা, পলা, সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র কিচ্ছু বাদ পড়েনি, কিন্তু তার নিজের মঙ্গল হলো কই! প্রতিপত্তিশালী ছেলের বাড়ির পরিচিত ডাক্তার পোস্টমর্টেম করে সার্টিফিকেট দিয়েছিল এটা আত্মহত্যা। ভাগ্যিস ওর বাবা ওর এই 'আত্মহত্যার' আগেই মারা গেছিলেন। এখনও ওর ফেসবুক প্রোফাইলের শেষ আপডেট, শেষ ছবি, শেষ about info সমস্তটা ওর স্বামী, সংসার আর সুখের জানান দিচ্ছে। আর ওর বরের প্রোফাইলের কভার পেজে মেয়েটির জন্য মরমিয়া বার্তা। সবটাই আছে, কেবল একটা মানুষ নেই।
আর তখন যারা প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন, মেয়েটির বন্ধুরা, শিক্ষিকা, আত্মীয়। আজ তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন এক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন যারা প্রচার করে একটা মেয়ে জন্মালে পাঁচটা গাছ পোঁতা উচিৎ, যাতে মেয়ের বিয়ের সময় সেই গাছের কাঠ কেটে মেয়ের বিয়ের 'খরচ' জোগানো যায়!
ফেসবুকীয় ২৪ ঘন্টা কেটে গেলে বোধ হয় সত্যিই এই মেয়েগুলোর নাম আর মনে পড়তে নেই।