ভিভি-র রাজনীতিকে বাদ দিয়ে, 'কবি ও সমাজকর্মী' - এমন একটা গোল পরিচয়ের দাবি, যেটাতে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা করার দায় নিতে হয় না। ছবিসূত্র: সীতাংশু শেখর।
অনীকের বয়ান (দ্বিতীয় কিস্তি)।।
আরবান নকশাল এই শব্দ বন্ধটা মিসলীডিং। কারণ শব্দটা প্রাথমিকভাবে কয়েন করা হয়েছিল, কোন একটা কিছুকে খারাপ বলে বুঝিয়ে, কিছু প্রতিবাদী মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ শানানোকে বৈধতা দিতে। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এই শব্দটাকে তৈরি করেছিল, গালাগালি দেওয়ার জন্য। প্রতিবাদের স্বতঃস্ফূর্ততায়, উল্টোদিকে গণতান্ত্রিক পরিসরের মানুষজন এটাকেই তখন নিজের পরিচয় বলে দাবি করলেন। সেটা একটা প্রতিবাদের প্রকাশ ছিল। তারপরে মিডিয়ার কল্যাণে এই শব্দবন্ধটাই এই প্রতিবাদী মানুষগুলোর পরিচয় হয়ে উঠলো।কিন্তু এই শব্দ গড়ে ওঠার কনটেক্সটটা বাদ দিলে, এই পরিচয়টা অসম্পূর্ণ।
আজকে একটা ভিডিও দেখাল সুনন্দ। একজন খুব উত্তেজিত ভঙ্গীতে বলছেন, আর্বান নকশালরা আসলে তোলাবাজির পয়সায় অ্যাকাডেমিক বা নাটক-সিনেমা-সাহিত্যের চর্চা করেন। মাওবাদীদের হয়ে কথা বলার জন্য তাঁরা এভাবে টাকা পেয়ে থাকেন।তাই আপনি তোলাবাজ রাজনীতিবিদদের যদি ঘৃণা করেন, তাহলে এদেরকেও আপনাদের ঘৃণা করতে হবে।
এমনিতে হোয়াটঅ্যাবাউট্রি এই সময়ের রাজনৈতিক তরজার মূল ধরণ।খুবই অশিক্ষিত একটা ধরণ।ওটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। কিন্তু ভিডিওটাতে আরও মজার কিছু ছিল।
প্রথমতঃ, ভিডিওটা যিনি করছেন, তাঁর একটা প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, বিজেপি নয়, এই কয়েনেজ-টা কংগ্রেসের। ইউপিএ আমলেই সুশীল সিন্ধে-র হলফনামায়, আর মাওবাদীদের তোলাবাজির টাকায় পুষ্ট আরবান নকশালদের কথা বলা হয়েছিল।এটা ভালো ব্যাপার, যে সরকারে ইউ পি এ থাকুক বা এন ডি এ, মাওবাদীদের সম্পর্কে তাদের অবস্থান যে এক, সেটা এই ভদ্রলোক নিজেই বলে দিয়েছেন।
কিন্তু ইনি এটা বলছেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে - ভারভারা রাও-দের বন্দী করার দোষের ভাগী শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসও এব্যাপারে একই অবস্থান। সেই হোয়াটঅ্যাবাউট্রির একরকম ডেরিভেটিভ। কিন্তু এটায় বোঝা গেল, উনি আপাততঃ বিজেপি-র অবস্থানটাকে ডিফেন্ড করতে চাইছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-তে এখনও অবধি সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী সদস্য সমর্থকদের কাছে স্বীকৃত নেতৃত্ব বলতে কিছু তৈরি হয়নি।দলীয় কোন নেতৃত্বের এমন কোন বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি যে দল তাকে সরকারের মুখ হিসেবে আপামর ভোটারের সামনে হাজির করতে পারে।
এটা যেমন দলের দিক দিয়ে একটা সমস্যা, একাংশের অ্যাসপিরেন্ট রাজনৈতিকদের কাছে এটা সুযোগও বটে।
এখানে যদি, নন-পার্টিজান, আপাত লিবারাল, কথায় কথায় গোমাতা বা মন্দির বলছেন না, মন্দির দিয়ে কথা শুরু ও শেষ করছেন না, খুব লাউড বিজেপি নন, কিন্তু বিজেপি-র প্রতিটি অ্যাজেন্ডাকে একরকম যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, এরকম কোন চরিত্র পাওয়া যায়, বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে পছন্দ করলেও করতে পারে।
এই চেষ্টাটা বেশ কয়েকজন করছেন এখন। কেউ একদমই ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে, কেউ কোন একটা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে নিয়েছেন, সেটা অ্যাকাডেমিক, মিডিয়া, শিল্প-সাহিত্য যেকোন কিছুর প্রতিষ্ঠান হতে পারে।
ফলে এই ভিডিওটি তৈরি করেছে, একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, খবরের শিরোনাম হয়েছে, বিজেপি-র কোন লিফলেট-এরই মতন, 'তোলাবাজদের চিনে নিন গোছের' এবং সেটিকে শেয়ার করা হয়েছে, বিজেপি-র বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে, যেমন - হাবড়া বিজেপি, জয়নগর বিজেপি, বাংলা হিন্দু সমাজ, অল বেঙ্গল আর এস এস ইত্যাদি।
দ্বিতীয়তঃ, ভিডিওটাতে একটা ওপরচালাকি আছে। গত মঙ্গলবার কলকাতার আলিপুর কোর্টে আগুন লাগার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, নারকোস ওয়েবসিরিজকে রেফার করে, ১৯৮৫-তে কলম্বিয়ার সুপ্রিম কোর্টে আগুন লাগানোর ঘটনার কথা বলা হয়েছে। যেটা পরে দেখানো হচ্ছে যে মাফিয়সির হয়ে সেখানকার মাওবাদীরা সেই আগুন লাগিয়েছিল।মঙ্গলবারের আলিপুর কোর্টের ঘটনার সঙ্গে মাওবাদীদের কোন যোগ আছে, এমন কোন দাবি কিন্তু তিনি করছেন না। আলিপুর কোর্টের আগুন প্রসঙ্গে, কলম্বিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আগুন প্রসঙ্গে একটা ওয়েবসিরিজ-এর বিষয়কে টেনে এনে, ছেড়ে রেখে দিয়েছেন। ভদ্রলোক সাংবাদিক, তাই একটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক রেফারেন্স-কে অ্যানেকডোট হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে কিছু ইঙ্গিত পুরে রেখেছেন। কারণ ওনাকে যেতে হতে মাওবাদ আর মাওবাদীদের নাশকতার গল্পে।
তৃতীয়তঃ, এখানে এসেই পুরোটা মাটি হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ - এটা মাওবাদীদের ঘোষিত অবস্থান। কারণ উন্নয়নের নামে, রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শোষণ করে, বড় পুঁজির প্রয়োজনে। - এটা একটা রাজনৈতিক অবস্থান, এটা সম্পর্কে কারো সমর্থন থাকতে পারে, কেউ বিরোধিতা করতে পারে।কিন্তু একটা যুদ্ধ যখন চলছে, তখন তার রসদ ইত্যাদিরও কিছু বন্দোবস্ত নিশ্চয়ই হয়।তার জন্য টাকা কড়িও লাগে। ফলে মাওবাদীদের দখলে যে অঞ্চলগুলো আছে, সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে এরকম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাওবাদীরা অর্থসংগ্রহ করে।প্রকাশ ঝা স্রেফ একটা সিনেমা বানাতে গিয়েও এটা পরিষ্কার বুঝলেন এবং দেখালেন।সেটাকে তোলাবাজি কেউ বলতেই পারেন। কিন্তু এন্ড রেজাল্টটা নিয়ে কথা বলাটা এড়িয়ে গেলেন। যুদ্ধের রসদ সংগ্রহ, তার অন্যান্য আনুষঙ্গিক সাপোর্ট সিস্টেমকে চালানো, ইত্যাদির জন্য অর্থ সংগ্রহকে আর সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তিগত তহবিল হিসেবে অর্থসংগ্রহকে একভাবে হাজির করে নিজের গোটা চেষ্টাটাতেই জল ঢেলে দিলেন।
এমনিতে কমিউনিস্ট পার্টি, মাওবাদী, ইত্যাদি নিয়ে, দক্ষিণপন্থী শিবির সবসময়ই একটা অতিসরলীকরণের সুযোগ পায় এবং নেয়। এটা প্রাথমিক ভাবে, ভারতবর্ষে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও, কমিউনিস্ট ও বৃহত্তর বামপন্থার একটা দুর্বলতা।
অন্যদিকে প্রভূত রাজনৈতিক অশিক্ষার কারণে এই চেষ্টাটা তরেও যায়।ফলে. মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সবকিছুকে এক ব্র্যাকেটে এনে, মাকু বলে চালানো যায়।যে চীন দীর্ঘদিন আগে, সমাজতন্ত্রের সাইনবোর্ড টুকু লাগিয়ে রেখে, আগ্রাসী বড় পুঁজির পথে যাত্রা করেছে, অন্য দেশের বাজার দখল করতে নেমেছে, তাকে মাও-এর চীন, মাওবাদ আর ভারতের মাওবাদীদের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার মতন রাজনৈতিক অশিক্ষাটা জিইয়ে রাখাটা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটা বড় দায়।
কিন্তু শিক্ষিত লিব্যারাল যে মুখ গুলো দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে জাস্টিফাই করার দায় নিয়েছেন, তাঁরা যেহেতু একটা পার্টিজান অবস্থান-এর বাইরে বিচরণ করেন, ফলে, মাঝে মধ্যে তাঁরাও, কিছু কথা বলে ফেলেন।
যেমন শ্রী জিষ্ণু বসু।গত সেপ্টেম্বরে, স্বস্তিকা-র একটা সংখ্যাই হয়েছিল, এই বিষয়ে, ‘শহুরে নকশাল নকশালদের থেকেও ভয়ঙ্কর'। যাতে এটাও একটা প্রবন্ধের বিষয় ছিল, ‘ইউ পি এ আমলে গ্রেফতারের সময় যাঁরা মুখ খোলেননি তাঁরাই আজ মুখর কেন’।তো, এই সংখ্যাতে জিষ্ণু বসু লিখেছিলেন,
‘ওঁরা (ভারাভারা রাও-রা) আসলে গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে’।
গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ মানে কী, বর্তমান ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক কিনা, ইত্যাদি প্রশ্নগুলোই তো দক্ষিণপন্থী এবং মাওবাদী রাজনীতির বিতর্কের বিষয়।
কিন্তু জিষ্ণুবাবু হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন অন্য বিষয়ে, মধ্যে যাঁরা এই দুই পক্ষের মধ্যে লাট খাচ্ছেন, তাঁদের ব্যাপারে।
উনি লিখছেন, ‘দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেলে কমিউনিস্ট হিসেবে সিপিএম, সিপিআই-এর দাম থাকবে নাকি? তারা চান না মাওবাদীরা জিতুক। ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকুক, না হলে সীতারাম সাহেবের সীট আর আরাম কোনওটাই থাকবে না।’
জিষ্ণুবাবু নিজেকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমর্থক। কিন্তু কখনই রাজনৈতিক শিক্ষায় অপরিণত নন। এবং নন যে, সেই দাবিটা ছাড়েননি। ফলে, সিপিএম এবং মাওবাদী-দের পার্থক্য যে দক্ষিণপন্থা বোঝে সেটা ঘোষণা করতে কুন্ঠাবোধ করেননি।
প্রথম ভিডিওটিতে সাংবাদিক ভদ্রলোক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির যেটা সবথেকে বড় অস্ত্র, রাজনৈতিক অশিক্ষা, সেটার ওপর বেশি ভরসা করেছেন। এমনকী নিজের পরিণত রাজনৈতিক বোধকেও লুকিয়েছেন ওই অশিক্ষার কাছে বেশি আবেদন তৈরি করার জন্য।
এর মধ্যে সিপিএম-এর এক যুবক নেতা, শতরূপ ঘোষ, তিনি বিকাশ দুবের এনকাউন্টারের পরে, বিকাশ দুবের সঙ্গে কিষাণজী-র পরিণতির মিল খুঁজে পেয়েছেন। ইনিও পরিণত রাজনৈতিক বোধ-এর থেকে বেশি ভরসা করেছেন, রাজনীতির গোদাপনাকে। তখনও বোধহয়, ভিভি-র মুক্তি চেয়ে এসএফআই-এর পোস্টার ছাপানোর সিদ্ধান্ত হয়নি, যেটা সম্ভবতঃ এই সময়ের সবথেকে বড় রাজনৈতিক রসিকতাগুলোর একটা।
ফলে, ভিভি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি নিয়ে, একটা পক্ষ সরাসরি বিরোধি অবস্থান নিয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। যুযুধান দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। দুপক্ষই নিজে ঠিক এবং অন্যকে ভুল প্রমাণ করতে চাইবে।শুধু এটুকু আশা করা যায় যে দুপক্ষের কেউই জেনেশুনে অশিক্ষার আশ্রয় নেবেন না।
আর এক দল, এই সিপিএম প্রভৃতি, ভিভি-র রাজনৈতিক পরিচিতিটাকেই বাদ দিয়ে একজন বয়স্ক অসুস্থ কবি হিসেবে দেখাতে চাইছে। কারণ ভিভি-র রাজনৈতিক অবস্থানটা পরিষ্কার হতে দিলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যায়।
(ক্রমশঃ)