এই সব শারীরিক দূরত্বের দিনগুলোতে রীণাদি-ফতিমাদিদের কথা মনে পড়ছে খুব। প্রতিদিনকার ভাত-ডালের ব্যবস্থা করতে যে অঞ্চলে আমার যাতায়াত,সোম টু শুক্কুর, ১০ টু সাড়ে ৫, তারই ধার ঘেঁষে ওদের ঘেটো। আদিম, আঁঠালো, ঘিনঘিনে। চাকরির কনফার্মেশন লেটার পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে এক সোশ্যাল ওয়ার্কার কাকিমা(বন্ধুর মা)-কে জানাতেই সপাট তিরষ্কার "ওসব জায়গায় আবার ভদ্রবাড়ির মেয়েরা যায় নাকি!"তা চাকরীর দেবতা আমার কপালে যদি ওই গৃহহারা ছন্নছাড়া কাজই জুগিয়ে দেন, কীই বা করতে পারি! ডানদিকে চিত্তরঞ্জন এভেনিউ ধরে মিনিট দশেক গেলে ওদের অলিখিত রাজধানী, বাঁদিক ধরে সোজা শিয়ালদামুখো হাঁটলে যারা সবার পিছে সবার নীচে,তাদের বসত। সকাল-সন্ধে দু'বেলা সরু তস্য সরু গলির রোয়াকে, মাছি ভনভন করা নর্দমার পাশে, ঘেয়ো নেড়ির গায়ে হেলান দিয়ে জটলা বাঁধা ক্যাটক্যাটে রুজ-লিপস্টিক লেপা, বুকের আঁচল-খসে পড়া নীরক্ত অপুষ্ট ছায়ামূর্তিদের নিয়ে দর কষাকষি চলে। ভদ্র পরিবারের 'লক্ষ্মী' মেয়ে আমি, ফুটপাথের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে পেরোতাম ওইসব বিপজ্জনক অঞ্চল।তারপর একদিন, হঠাৎ, কাজের সূত্রেই ওদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়লাম আমরা ক'জন। এই একটাই জায়গা, যেখানে কাজের চেয়ে গপ্পো করতাম বেশী, ওদের কথা শুনতে শুনতে পুরনো নোনা-ধরা দেওয়ালের ভেঙে পড়ার আওয়াজ পেতাম, নিজের ভেতরে। লিঙ্গ আর যৌনচাহিদার রকমফের ছাড়া বাকি সব ব্যাপারে অপার সাম্যবাদ দেখলাম, সবচেয়ে বেশী দেখলাম শোষণের সাম্য। ওখানকার কাজ আমাদের মিটে গেছে, তবু মাঝেমাঝে কানে বাজে ....."আমাদের এখানে তো মেয়ে অডিটর কখনো আসেনি এর আগে, আপনারা এলেন দিদি, খুব আনন্দ পেলাম।"
সমাজের মূলস্রোত থেকে দূরে থাকাটাকে ভবিতব্য মেনেই তো ওরা বাঁচে,আর ক্ষুন্নিবৃত্তি করে শারীরিক নৈকট্যকে ব্যবহার করে। আজকের এই সামাজিক নৈকট্য আর শারীরিক দূরত্বের এই টানাপোড়েনের দিনগুলোয় .... কেমন আছে ওরা? ভদ্দরলোক বাবুরা তো আর মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ফুর্তি কিনতে যাবে না এসময়ে! সরকারী বেসরকারী ত্রাণবন্টনের লিস্টিতেও কি ওদের নাম থাকবে? সুদিন ফিরলে কি কীটনাশক স্প্রে করে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হবে ওদেরও?
কে জানে!!