প্রায় অনন্তকাল ধরে সরকারী চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি পাওয়া সহকর্মীদের সংস্পর্শে এসেছি। সরকারী আপিসের নিজস্ব উপভাষা অনুযায়ী ১০ জনের মধ্যে অন্তত ৭জন যাকে 'কম্পেনসেশন গ্রাউন্ড' নামে ডাকেন। যেন যমরাজের কুকীর্তির ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন স্বয়ং সরকার-বাহাদুর!!
আমার অভিজ্ঞতায়,কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকুরিরত কর্মচারীদের মোটামুটি দু'ভাগে ভাগ করা যায়।হয় মৃত কর্মচারীর পুত্র বা কন্যা অথবা মৃত কর্মচারীর স্ত্রী।এই পুত্র বা কন্যারা তুলনায় কমবয়সী, হয়তো সবে পড়াশোনা শেষ হয়েছে বা হবে, উৎসাহী, স্মার্ট, এনার্জেটিক।বাবা বা মায়ের অকালমৃত্যুর ফলে চাকরিটি পেয়ে গেছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো নিজের চেষ্টায় আরো ভালো চাকরি পেতে পারতো কিম্বা চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত, ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়তো,কেউ বা হয়তো সরকারী চাকরির চৌহদ্দির বহু দূরে গ্রুপ থিয়েটার বা নেচার ফটোগ্রাফি করতো। কেউ চাকরি পেয়ে খুশী, কেউ ততো খুশী নয়।তবু,কম বয়স,স্বচ্ছ দৃষ্টি, ঝকঝকে জীবনবোধ... সব মিলিয়ে ওরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা খুঁজে নেয় অচিরেই, এখানে বা অন্য কোথাও।
মুশকিল হয় অন্য গোত্রটির।যাঁরা এক ঝটকায় নিজের হাতে পরম যত্নে গড়া পরিপূর্ণ ঘরকন্নার মায়া পেছনে ফেলে বারো ভূতের মেলায় এসে অধিষ্ঠিত হন।উর্বীদির সঙ্গে আমার আলাপ জেলায় বদলি হওয়ার পর।আমাদেরই সিনিয়র বিতানদা, তাঁর স্ত্রী।বিয়ের দু'বছরের মধ্যে তিনদিনের জ্বরে বিতানদা চলে যান।ছ'মাসের মেয়েকে নিয়ে উর্বীদি তখন অথৈ জলে।তারপর অনেক লড়াই,লালফিতের জট পেরিয়ে সহকর্মীর স্ত্রী যখন নিজেই সহকর্মী হয়ে উঠলেন, 'বিধবা' 'যুবতী' 'সুন্দরী' সহকর্মী.... কতরকম প্রতিক্রিয়া চারপাশে! অতি-উৎসাহী হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া,না ধরলে হাতের মালিক টাইট দেবে, ধরলে অন্যদের চোখ- টেপাটেপি অথবা বরফশীতল নিস্পৃহতা! সেইসব উতরে আস্তে আস্তে নিজের জায়গা খুঁজে নিলো উর্বীদি, ততোদিনে মায়াকাজলের রেশটুকু মুছে গিয়ে হিসেবী চাতুর্য বাসা বেঁধেছে ওঁর দীঘির মত চোখজোড়ায়।
বনানীদির গল্পটা অন্যরকম।উত্তর কোলকাতার রক্ষণশীল গৃহবধূ,নিঃসন্তান। প্রায় পঞ্চাশ পেরিয়ে কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি।গেরস্থালিটাকে প্রায় কোলে করে নিয়ে আসতেন আপিসে। আলুথালু শাড়ি, ভিজে চুল, বগলে ব্যাগ, দৌড়ে দৌড়ে এসেও রোজ লাল কালি,ঠেস মারা কথা (মাইনেটা তো প্রত্যেক মাসে থুতু দিয়ে গুনে নেন বৌদি, রোজ দেরী করলে চলবে??), হাসাহাসি.... এসব ছিল রোজকার রুটিন।এই 'দেওর'রাই আবার দেড়টা বাজতে না বাজতে হামলে পড়তো বনানীদির আনা কুমড়োর ছক্কা কিম্বা ডুমুরের ডালনা-ভর্তি টিফিনবাক্সের ওপর।বনানীদিও বেলা এগারোটার অপমান ভুলে পরম তৃপ্তিতে খাওয়াতেন,"আর দু-চামচ নিন না"-টাইপের অনুনয় লেগে থাকতো ঠোঁটের কোণে। ওই জিপিএফ, গ্র্যাচুইটির নোটশিট,পে-বিল, ক্যাশবই-ওগুলো আসল বনানীদি হয়ে উঠতেই পারেনি কোনোদিন, আসল বনানীদি লুকিয়ে ছিল ওই মোচার ঘন্ট, বড়ির ঝাল আর মায়ের মত যত্নের ভেতরটাতে।
আজকাল মাঝেমাঝেই বনানীদিকে মনে পড়ে আমার।জীবনের পঞ্চাশটি বছর কুটে- বেটে, শুক্তো-ঘন্ট-ডালনা-অম্বল রেঁধে, অতিথ- বিতিথকে যত্নআত্তি করে,উপোস-ষষ্ঠী-ব্রত ইত্যাদিতে কাটিয়ে দেওয়ার পর ভাগ্যের ফেরে অনন্যোপায় হয়ে দশটা-পাঁচটার জোয়ালে জুতে যেতে হলে, তার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী আছে! আজকে যতই না কেন নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াই করোনা আমাকে 'পার্ট অফ হিস্ট্রি'তে পরিণত করেছে বলে,আসলে তো করোনা আমাকে, আমাদের প্রত্যেককে ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে নিজেদের কমফর্ট জোন থেকে, বনানীদির মতোই.... রান্নার দিদির একটিবেলার কামাইতে মুখ হাঁড়ি করার ন্যাকামি থেকে,প্রতি উইকেন্ডে সুইগি- জোম্যাটোর শর্টকাট থেকে, ভুরুপ্লাক- ফেসিয়ালের আত্মরতি আর মিসেস ম্যাগপাই-ফার্স্টফ্লাশের বিলাসিতা থেকে! অডিট পেন্সিল, ল্যাপটপ, ব্যালেন্স শিট ছাপিয়ে জীবন এখন 'যদি খাবে তবে রাঁধো,নইলে পেটে গামছা বাঁধো' -তে পর্যবসিত। সালোকসংশ্লেষটুকু অধরা রয়ে গেছে, বাকি ওনার নির্দেশ মেনে ফুল আত্মনির্ভর।
করোনা আসলে আমাদের সব্বাইকে চুলের মুঠি ধরে একেকজন বনানীদি বানিয়ে দিয়েছে এক ঝটকায়!!