কলকাতা কমন্স

রাষ্ট্রপরিচালনায় গৃহীত নীতিগুলির পরিসংখ্যানগত মূল্যায়ন-এর উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে অঙ্ক, অর্থনীতি, পদার্থবিদ্যা ও রাশিবিজ্ঞান-এর কয়েকজন গবেষকের চেষ্টায় তৈরি হয়, 'রিসার্চ কালেক্টিভ'। শুরুতে এটি একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল।পরবর্তীতে, ২০১৫ সালে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তায়, একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ হিসেবে, 'কলকাতা কমন্স' গড়ে ওঠে।

রাষ্ট্রনীতিগুলির পরিসংখ্যানগত মূল্যায়ন-এর কাজের প্রয়োজনে গবেষণার কাজগুলি আরও বিস্তৃত হয়। সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বোঝাপড়া তৈরি করতে, আঞ্চলিক সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও তার ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়গুলি ক্রমশঃ চর্চা ও গবেষণা-র অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠে।অঞ্চলভেদে জীবন ও জীবিকার ধরণের পার্থক্য, পরম্পরাগত জ্ঞান ও সংস্কৃতির চর্চা, পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ধরণ, ইত্যাদি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়।

২০০৭-০৮ সাল নাগাদ অ্যানালিটিক্স শব্দটির ঠিকঠাক বাংলা কী হতে পারে, সে সম্বন্ধে একাধিক বিশেষজ্ঞ-র সঙ্গে আলোচনা করেও কোন নির্দ্দিষ্ট শব্দ বা শব্দবন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল না। তখনও, পরিচিত ওয়ার্ড প্রসেসর গুলোতেও যে ডিকশনারি অ্যালগরিদমগুলো থাকত, তাতে ইংরেজিতে অ্যানালিটিক্স লিখলে, সেটাকে ভুল ঠাউরে, শুধরে দেওয়ার জন্য লাল রঙ-এ দাগিয়ে দিত।ঠিক সেরকমই, পলিসি রিসার্চ-, ধরা যাক, একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ঠিক কতজন মানুষ দারিদ্রসীমারেখার নীচে বাস করেন এবং, তাঁদের মধ্যে কতজনের পরিবারে কতগুলি জবকার্ড থাকলে, ঠিক কত শ্রমঘন্টার সরবরাহ পাওয়া যেতে পারে, এবং তা দিয়ে গ্রামের প্রয়োজনীয় কোন ধরণের সম্পদ (পণ্য বা পরিষেবার) কতটা তৈরি হতে পারে, এবং তার মূল্যমান কীভাবে ঠিক করা যেতে পারে, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সঙ্গে পলিসি রিসার্চ-এর বাংলা হিসেবে, 'নীতিশাস্ত্র' সম্পর্কিত চালু ধারণাটা গন্ডগোল পাকিয়ে তুলছিল।

তাই, পলিসি-রিসার্চ-এ ডেটা সায়েন্স-এর প্রয়োগ নিয়ে প্রথম যখন একটা উদ্যোগের পরিকল্পনা হয়, ২০০৭-০৮ নাগাদ, তখন উদ্যোগটার নাম দেওয়া হয়েছিল, রিসার্চ কালেক্টিভ।তারপরে দেখা গেল, তথ্য সংগ্রহের জন্য যে সমস্ত জায়গায় যেতে হচ্ছে, বিশেষতঃ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে, 'রিসার্চ কালেক্টিভ' নামটুকু যথেষ্ট হচ্ছে না। একটা কোন আইনি পরিচয়ের প্রয়োজন পড়ছে।

পলিসি রিসার্চের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, প্রাথমিক ভাবে, পাঠ্য অর্থনীতিতে 'পাবলিক গুড্স' বলে পরিচিত ধারণাটি নিয়েই রিসার্চ কালেক্টিভ-এর গবেষণার কাজগুলো শুরু হয়েছিল।অন্য কিছু নামকরণের সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে দেখা গেল, 'ষোলআনা' বা 'বাইশা' বা 'পঞ্চায়েত' – এই শব্দগুলো হয় অব্যবহারে মানুষের স্মৃতি থেকে চলে গেছে নয়তো অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃত হতে হতে এমন একটা মানে তৈরি হয়েছে, যে কোন সম্পদের ওপর বা সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার ওপর সামাজিক মালিকানা বোঝাতে এই বাংলা শব্দগুলো ইংরিজির থেকেও বেশি জটিলতা তৈরি করতে পারে।

এর মধ্যে ২০০৯-'এলিনর অস্টর্ম' অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার কারণে, এবং দ্য কমন্স কথাটি বেশ পরিচিত হয়েছিল। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা ছিল, কমন্স কথাটি ব্যবহার হচ্ছিল, একটা সমষ্টি অর্থে, মূলতঃ 'উইলিয়াম ফর্স্টার লয়েড’-এর 'ট্রাজেডি অফ কমন্স' থেকে ধার করে। 'জন ভন নিউম্যান' বা 'জন ন্যাশ’-এর হাতে 'গেম থিওরি’-তে 'কমন্স’-এর ধারণাটা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিচিত হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু ওই সমস্যাটা ছিলই – 'কমন্স' মানে এমন একটা যূথবদ্ধ সমষ্টি, যাকে গভার্ন (শাসন, আরও সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ) করতে হয়।

ষোলআনা, বাইশা, পঞ্চায়েত ইত্যাদি শব্দগুলোর মধ্যে যে স্বাধীন সমষ্টির ধারণা ছিল, যে স্বাধীন সমষ্টি জবাবদিহি করে শুধু বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থের কাছে, সেটা কমন্স-এর ধারণায় এঁটে ওঠে না, ওটা কমন্স-এর ধারণা ছাড়িয়ে আরও বেশি কিছু।

কিন্তু দীর্ঘদিন-এর অব্যবহার আর অন্য ব্যবহারে শব্দগুলো বুঝতে ভুল হতে পারে, এই আশঙ্কায়, ২০১৫ সালে, রেজিস্ট্রেশনের সময়, কমন্স নামটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। পুরো নামটা দাঁড়ালো,

'কলকাতা কমন্স সেন্টার ফর ইন্টারডিসিপ্লিনারি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স'

যদিও আইনি পরিচিতিটা এই নামেই, এখনও বাংলায় একটা যথাযথ প্রতিশব্দের খোঁজ চলছে।

বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই কলকাতা কমন্স (Kolkata Commons) ঢুকে পড়েছিল, সাহিত্যের ক্ষেত্রে। সেটা খানিকটা অনধিকার চর্চাই ছিলো শুরুর দিকে। কারণ মূলতঃ অঙ্ক ও পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর ভর করেই, কলকাতা কমন্সের কাজ শুরু হয়েছিল। কাজের ক্ষেত্র ছিলো মূলতঃ পলিসি রিসার্চ। কিন্তু অচিরেই দেখা গেলো প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তথ্য ও সংখ্যার অকুলানের কারণে, আমাদের Statistics ছেড়ে অনেক বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে, Cultural Studies-এর উপর।

২০১৬ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে, আমরা শুরু করি, ‘কথোপকথন’। কথোপকথনের চেষ্টাটা প্রথম যখন শুরু হয়েছিল, ভাবনাটা ছিল, একটা সমন্বয়ের, বিনিময়ের জায়গা তৈরি করা। যেকোন ধরণের সৃজনশীলতাকে নিয়ে, স্রষ্টা ও দর্শক-শ্রোতার মধ্যে।  শুরুতে অবশ্য সবথেকে বেশি সময় গেছে, চর্চার এই চেনা অথচ অনুশীলনে না থাকা অভ্যাসটা তৈরি করতে। যাঁরা কথোপকথনে যোগ দিচ্ছেন, সবাই নির্ভয়ে, নিজেদের মনে হওয়া, বুঝতে না পারা, প্রশ্ন ইত্যাদি রাখতে পারবেন, কোনরকম কৌলীন্য বা কৃতবিদ্যতার দাবী যেন চর্চার পরিসরটাকে বিঘ্নিত করতে না পারে।

বাঙালীর জ্ঞানচর্চার যে বাচিক অভ্যাস সেই ধারাটুকুকে বজায় রাখার কথা মাথায় রেখেই ‘কথোপকথন’ এর সূত্রপাত। বাংলার আর বৃহত্তর বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির যে বহুমুখী বিস্তার, তার উৎস, বিবর্তন, প্রভাব আর তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ এই সমস্তই বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করতে চাওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিকতার প্রথাগত রীতি ছাড়াও তাই ‘কথোপকথন’-এর নিজস্ব ধরণে সংরক্ষণের চেষ্টায় প্রথম থেকেই 'কলকাতা কমন্স’-এর পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, বিভিন্ন বিষয়কেন্দ্রিক আলোচনার, যেখানে প্রচলিত আলোচনাসভার বক্তা-শ্রোতার সম্পর্কের বাইরে গিয়ে চেষ্টা ছিল বারোয়ারিতলার আড্ডার পরিবেশ তৈরির, যেখানে আদান-প্রদান-টা সহজ হতে পারে। যে কোন বিষয়েই একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর বদলে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মানুষেরা কি ভাবছেন তার সঙ্গে সঙ্গে কৃতবিদ্যতার দাবিহীণ সাধারণ মানুষের প্রশ্ন ও ভাবনাগুলোও ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে এই আলোচনাগুলিতে। আশা এই যে, এই চর্চাগুলোর মধ্য দিয়ে উঠে আসা আলাদা আলাদা ভাবনাগুলো প্রভাবিত করবে উপস্থিত মানুষগুলিকে, তাঁদের ভবিষ্যতের চিন্তা আর কাজের পদ্ধতিকে, ফলশ্রুতিতে চর্চার পরিসরটাও বাড়তে থাকবে।