কলকাতা কমন্স

বোঝাপড়া

গ্রামীণ সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে বোঝার পাঠ্যবই কেন্দ্রিক উপায়গুলো সেগুলো আমাদের চর্চায় এমনভাবে এঁটে বসেছে, যে বড় পুঁজি, বড় শিল্প, মুনাফামুখী অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন, বড় বাজার সংক্রান্ত অর্থনৈতিক বোঝাপড়াগুলো দিয়েই গ্রামীণ অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করাটা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই ব্যাখ্যার যে মূল প্রকল্প সেটাকে প্রশ্ন করা বা যাচাই করার মতন অবকাশ ঘটে কম।এবং অদ্ভূত ভাবে, লেখককে অতিক্রম করে পাঠ-কে দেখার যে অভ্যাস প্রাচ্য জ্ঞানচর্চার ধারায় বরাবরই ছিল, সে অভ্যাসও ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে থাকল।এব্যাপারে যথাস্থানে আরও বিশদে আলোচনা হওয়া সম্ভব, কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝার জন্য কিছু উদাহরণ দেওয়াই যায়।

শ্রী রমেশ চন্দ্র দত্ত, ভারতবর্ষের দ্বিতীয় আই সি এস অফিসার, যিনি নিজে কখনই ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ চাননি, বরং শাসনে ভারতীয়দের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করাটুকুতেই খুশি ছিলেন, তিনি, লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে প়ড়ানোর সময় যখন দুই খন্ডে ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া লিখছেন, তখন তিনি মূলতঃ লিপিবদ্ধ করছেন, বৃটিশ শাসনে কীভাবে এই ভূখন্ডের গ্রামীণ সামজিক স্বায়ত্তশাসনের বোঝাপড়া-টা ভেঙে যাচ্ছে।বৃটিশ পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে বৃটিশ শাসনের তুলনা করে, রমেশ চন্দ্রের ওই ডকুমেন্টেশন পরবর্তীতে, সশস্ত্র ও অহিংস নির্বিশেষে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মীদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিলের কাজ করেছে। কিন্তু তারপরে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে, রমেশ চন্দ্র দত্ত-এর পরিচয়টা আই-সি-এস, বিলেতে পড়ানো ইত্যাদি পরিচয়ের মধ্যেই আটকে দেওয়া হয়েছে, তাঁর সবথেকে বড় কাজটার দিকে খুব কমই ফিরে দেখা হয়েছে। ফলে স্বশাসিত গ্রামসমাজ কেমন হতে পারে, তার তত্ত্বায়ন, শিল্পকেন্দ্রিক নগরকে চেনার পাঠক্রম থেকে ক্রমশঃ পিছু হটেছে। রমেশ চন্দ্র দত্ত, বা তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসকে জানার নিয়মিত পাঠক্রমে কেউই আর গুরুত্ব পেলেন না।

তাই, পরিকল্পনার স্তরেই যে বোঝাপড়াটা ছিল, জ্ঞানচর্চার পরিসরকে প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে সামাজিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে, প্রাতিষ্ঠানিক ধরণগুলোকেও বাদ দিতে পারলে ভালো হয়।

আমাদের এই বোঝাপড়াগুলোই আমরা এখানে রাখতে চাই। এবং তার সঙ্গে এই কথাটা পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমাদের যে এই  বোঝাপড়াগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোই একমাত্র ও চূড়ান্ত বলে আমরা মনে করি না। সম্মতি, শর্তসাপেক্ষ সম্মতি ও আপত্তি দুইই থাকতে পারে। বরং সেগুলো জানতে পারলে, সেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা হলে, বোঝাপড়া-টাও বাড়বে, এটাই আমাদের ধারণা।

DW Studios-এর ওয়ার্কশপ-এর ছবি
DW Studios-এর ওয়ার্কশপ-এর ছবি

আমরা শুধু এটুকু বলতে চাইছি, এবং জোর দিয়ে বলছি যে, এটাই ফুলিয়াতে হওয়ার কথা ছিল। বা উল্টোদিক দিয়ে বললে, ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায়, বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদনকে সুনিশ্চিত করার জন্য ফুলিয়ার মডেলটাই প্রয়োজনীয় ছিল। এবং এই প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য বাজার কোন দায়িত্ব নেয়নি। সামাজিক জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে, পুঁজির যোগানের জন্য সামাজিক সমঝোতাকে ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছে।

ফুলিয়া। ছবি সৌজন্য DW Studios
ফুলিয়া। ছবি সৌজন্য DW Studios

কলকাতা কমন্স-এর বয়নশিল্পে উৎপাদন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলো একান্তই ফুলিয়া-কেন্দ্রিক। নিজেদের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, আরও কিছু রসদ আমরা পেয়েছি ফুলিয়ার বিভিন্ন মানুষের কাছথেকে। তাঁদের এবং আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলোর ভিত্তিতে আমাদের কিছু নিজস্ব বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। তাঁদের, সিদ্ধান্তগুলো একান্তই আমাদের। আমরা ধারাবাহিক ভাবে, এখানে সেগুলো রাখার চেষ্টা করছি।

হ্যান্ডলুম ব্র্যান্ড উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী
হ্যান্ডলুম ব্র্যান্ড উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী। ছবি সূত্র - টুইটার।

এর আগে হ্যান্ডলুম এবং হ্যান্ডলুম বোর্ড-এর শুরুর সময়টা নিয়ে যে লেখাটা হয়েছিল, তারপরে আমরা বেশ কিছু প্রশ্ন পেয়েছি। হ্যান্ডলুম বোর্ডের বিলুপ্তি নিয়ে আমাদের বোঝাপড়াটা আরও বিশদে লিখতে বলেছেন অনেকে। বিলুপ্তি-র প্রক্রিয়াটাকে বুঝতে আগে একবার অতীত পরিক্রমাটা হওয়া দরকার বলে আমাদের মনে হয়েছে।

Lady spinning in charkha

প্রধানমন্ত্রী নিজে চরকায় বসেছেন। তাঁর সঙ্গে, সস্ত্রীক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। তাও সংখ্যাগরিষ্ঠ উপভোক্তার কাছে, হ্যান্ডলুম বিষয়টা বোঝা শুরু হল, তাঁত থেকে। সুতো তৈরি, রং করা, এই সব পর্যায়গুলোই জনমানস থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া হল। ছবি - সংগৃহীত।