কলকাতা কমন্স

মসলিন-এর সান্ধ্য পোষাক। ১৮১০। মসলিন-এর ওপরে সোনার সূচীশিল্প। ছবি সৌজন্য - মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ম।
মসলিন-এর সান্ধ্য পোষাক। ১৮১০। মসলিন-এর ওপরে সোনার সূচীশিল্প। ছবি সূত্র - মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ম।

হ্যান্ডলুম বোর্ড সংক্রান্ত যে লেখাটা এর আগে প্রকাশ করা হয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়া মিশ্র।
শুরুর সন্দীপনী পাঁয়তারাটা কারোর অতিরিক্ত মনে হয়েছে, কারোর কাছে ইন্টারেস্টিং। কেউ কেউ তারাশংকর আর জসিমুদ্দিন-এর লেখালেখির আলোচনার অজুহাতে, গ্রামীন পরম্পরা সমাজ আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ধারাবাহিক লেখা হওয়া উচিৎ বলে মনে করেছেন। ভাগলপুর দাঙ্গা এবং রেশম সুতোর সম্পর্ক প্রায় সকলকেই চমৎকৃত করেছে। শুধু এই বিষয় নিয়েই একটা ওয়েবসিরিজ বানানো যেতে পারে, এরকমও বলেছেন অনেকে। কারও সমস্যা হয়েছে, লেখাটার সঙ্গে লেখকের নাম নেই বলে। লেখকের নাম জানতে চেয়েছেন।
শেষ থেকে শুরু করা যাক। এই লেখাটা কোন একজনের লেখা নয়। অন্ততঃ পাঁচজনের ভূমিকা আছে, এই লেখাটা তৈরি করতে। অনেকেই হয়তো জানেন, কলকাতা কমন্স-এর অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে আছেন, বাংলার তাঁত ও তাঁতীরা। আমাদের কাজের শুরুর দিকে, আমরা অতি উৎসাহে, শাড়ি-র সঙ্গে ক্রেতার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে শাড়িগুলোতে তাঁতিদের নাম লিখতাম। তাঁতিরা কেউ কোনদিন বলেননি কিন্তু। এমনকি তাঁতিদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ও ছবি পর্যন্ত দেওয়ার কথা হয়েছিল। সেসব উদ্যোগের মধ্যেই আমরা বুঝলাম, শাড়িটা শুধু একা তাঁতির নয়। কাটনি-র, ডায়ার-এর, যে নলী তৈরি করল, ড্রামমাস্টার-এর যিনি সানাতে সুতো পড়িয়ে বোয়া তৈরি করলেন, এঁরা সবাই মিলে শাড়িটা বানাচ্ছেন। হ্যান্ডলুম শব্দটার আদিখ্যেতা শুধু তাঁতী থেকে শুরু হলে, সুতো নাটানো, টানা হোতানো এই কাজগুলো বাতিল হয়ে যায়, কারণ সুতো তৈরির পর্যায়টা আর হ্যান্ডলুমের বোঝাপড়ার আওতায় থাকে না। এই বাদ দেওয়ার ফেরতা প্রভাব পরে তুলো বা রেশমচাষীর ওপরে।

সেজন্যই পরী, মদন তাঁতী-র রেফারেন্স-টা এনেছিল। কারণ মদন তাঁতির বেইমানি না করার অনুষঙ্গ-টা বুঝতে সুতোর ভাল-মন্দ, সুতোর দামের ওঠা নামা ও নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি, ভুবনের দেওয়া সুতো (শুধুই নিকৃষ্ট বিবেচনায় নয়) প্রত্যাখ্যান করা, এগুলো সবকিছু বুঝতে হয়।
সন্দীপনের গদ্য ছাড়া, সন্দীপন নিয়ে অন্য কোন ব্যাজার আলোচনা যাতে তৈরি না হয় সেই অতি সতর্কতাটা কাজলের। তারাশংকর আর জসিমুদ্দিন সম্পর্কে বোঝাপড়াটাও, বেশিরভাগটাই কাজল-এর। পরী-র রিসার্চ, শানু-র লেখা, আর তারপরে, সিরাজুল আর কাজল-এর এডিটিং, যাতে একটাও বিশেষণ না থাকে। গোটাটার তত্ত্বাবধান করেছে আরও দুজন।

ফ্রান্সিস বালথাজার সলভিনস নামে এক বেলজিয়ান শিল্পী, স্যর উইলিয়াম জোনস-এর উৎসাহে ১৭৯৯-তে বাংলার দৈনন্দিন জীবন নিয়ে এথনোগ্রাফিক পোর্ট্রেট-এর একটা সিরিজ তৈরি করেন। ১২ খন্ডে সেটা প্রকাশিত হয়।সলভিনস-এর বক্তব্য ছিল, ইওরোপিয়ান স্কলার-রা যাঁরা ভারতের ইতিহাস ও ভূগোল নিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি লিখেছেন, সেগুলোতে ভারতীয়রা মোটেই সঠিকভাবে উপস্থাপিত হননি। এই লেখাটার সঙ্গে আমরা সলভিনস-এর সিরিজ-এর কিছু ছবি ব্যবহার করেছি।

এর আগে মসলিনের ওপরে সোনার সূচীকর্মের যে সান্ধ্য পোষাকটা দেখলেন, ১৮১০ সালের। আর সেই মসলিনের সূক্ষতা যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের ছবি আঁকছেন সলভিনস, ১৭৯৯ সালে। পাশে ওই সময়ে কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে আসা একজন মহিলার ছবি। মহিলার শাড়ির পাড় আঁচল, গয়না, আর সবার ওপরে বডি ল্যাংগুয়েজ-টা খেয়াল করবেন। ছবিসূত্র - ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস।
এর আগে মসলিনের ওপরে সোনার সূচীকর্মের যে সান্ধ্য পোষাকটা দেখলেন, ১৮১০ সালের। আর সেই মসলিনের সূক্ষ্মতা যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের ছবি আঁকছেন সলভিনস, ১৭৯৯ সালে। ডানপাশে ওই সময়ে কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে আসা একজন মহিলার ছবি। মহিলার শাড়ির পাড়-আঁচল, গয়না, আর সবার ওপরে, বডি ল্যাংগুয়েজ-টা খেয়াল করবেন। ছবি সূত্র - ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস।

এই যে এডিটোরিয়াল টীমটা এই গোটাটাই, এখানে প্রকাশিত প্রতিটা লেখার পিছনে আছে। তাই আলাদা করে কোন নাম দেওয়ার প্রশ্ন নেই। এবং এই টীমটার মধ্যে অনেক কিছু নিয়ে মতপার্থক্য আছে, যেমনটা থাকা স্বাভাবিক ও শোভন। কিন্তু একটা ব্যাপারে একচ্ছত্র মতৈক্য আছে - ফেসবুক কে সিরিয়াসলি নেওয়ার কোন কারণ নেই। কেন্দ্র সরকারে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ক্যাম্পেন করলেও নেই, না করলেও নেই।
এবং ইতিহাস। গিলিয়ে দেওয়া ইতিহাস নিয়ে অহেতুক উত্তেজনার কোন কারণ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী, কয়েক খেপে বেশ কয়েকশো কোটি টাকার বিনিয়োগে তৈরি একের পর এক হিন্দি সিনেমায়, আকবরের বউ-এর নাম, জয়পুরের হীরাবাই (বা হরকা বাই)-এর বদলে যোধাবাই (মানে যোধপুরের যে কোন মহিলাকে যা বলা যেতে পারত) জেনে এল।কারণ কলোনেল জেমস টড, তাঁর 'দ্য অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটি অফ রাজস্থান’-এ ভুল করে তাই লিখেছিলেন।

সুতি দিয়ে এমব্রয়ডারি করা মসলিন গাউন। ১৮০০ সাল। সাদা-র ওপরে সাদা এমব্রয়ডারির অনবদ্য নান্দনিক আবেদন।ছবিসূত্র - ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম।
সুতি দিয়ে এমব্রয়ডারি করা মসলিন গাউন। ১৮০০ সাল। সাদা-র ওপরে সাদা এমব্রয়ডারির অনবদ্য নান্দনিক আবেদন।
ছবি সূত্র - ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম।

গেলা ইতিহাস খুব কাজের জিনিস নয়। এব্যাপারে আমরা পরে আরও কথা বলবো।
এবং এরকম ভাবেই বলব। একথা বলতে গিয়ে অন্য কথা পাড়ব। সে কথা থেকে আরেক কথা। কারণ এখানে, ভাল প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লেখার নিয়ম মেনে, লেখা তৈরি হচ্ছে না। একটা বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছে। এবং এমনটাই আমরা হতে দেখি। একথা থেকে সেকথা, এরকম করেই, ফুলচাষী রহমানদা বোঝেন, মাটির কাজের সুবলদা বোঝেন, জামদানি তাঁতী সুরেনদা বোঝেন, বড়ি দেওয়ার কমলাদি বোঝেন, কাঁথার নীলুদি (নীলোফার) বোঝেন। এঁদের প্রতিটা ছোট-বড় সিদ্ধান্তের মধ্যে আমরা রোজ দেখি, এঁদের ছোটবেলা থেকে শুনে আসা গল্পগুলো কেমন ঢুকে থাকে, প্রথম প্রথম সে গল্পের প্রাসঙ্গিকতার ধরতাই পেতাম না আমরা, এখন বুঝি ওই রেফারেন্স ফ্রেম তৈরি করার অভ্যাস-এর যে এপিস্টেমোলজিকাল প্র্যাকটিস, ওই তাত্ত্বিক অবস্থানটা আয়ত্ত্ব করা ঠিক কতটা কঠিন।
পাঠক, যিনি পড়বেন, তিনি শুধু বোঝাপড়ার সিদ্ধান্তের শরিক নন, এই বোঝাপড়া গুলো তৈরি হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া তারও শরিক। প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পাঠককেও খানিক এই প্রক্রিয়ায় জড়াতে হবে। শুধু পড়ে যাওয়াটায় তাঁর দায়িত্ব শেষ না হওয়াটাই কাম্য। তা যদি হত, তাহলে আমরা এখানে নিদান দেওয়ার মতন সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ভাবতাম। বোঝাপড়াগুলো তৈরি করার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতাম না।এ নিয়ে পরে কোন আলোচনা হতেই পারে, বিশেষ করে দেবেশ রায় যেখানে, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য নামে একটা চমৎকার কাজ করেই রেখেছিলেন।

হ্যান্ডলুম বোর্ড প্রসঙ্গে ফেরার আগে, এই পাটিগণিত-টা একবার দেখুন তো!
'ক' আর 'খ' দুটো দেশ। 'ক' থেকে আগে 'খ' তে যা রফতানি হত সেটা 'ক’-এর মোট রফতানির, তিন শতাংশ। কয়েক দশকের মধ্যে, 'ক' থেকে 'খ’-তে যা রফতানি হয়, সেটা 'ক’-এর মোট রফতানির সাড়ে বারো শতাংশ। মানে, 'ক’-এর রফতানির বাজার হিসেবে, 'খ’-এর গুরুত্ব চারগুণ বেড়েছে।
এবারে ভাবুন, এই যে রফতানি বেড়েছে, তার মধ্যে একটি বিশেষ পণ্য আছে, ধরা যাক, 'প'। এই 'প' পণ্যটি 'ক' মোট যা রফতানি করে, তার ২৫ শতাংশই করে 'খ’-তে। পণ্যের মাপে দেখলে, দুই দশকেরও কম সময়ে 'ক' থেকে 'খ’-এ, প পণ্যের রফতানি বেড়েছে, ৫২০০ গুণ। এই সময়ে শুধু 'প’-এর উৎপাদনেই 'ক' দেশের ১২ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং 'ক'-এর জাতীয় আয়ের নয় শতাংশ আসে শুধু 'প’-এর উৎপাদন থেকে।অন্যদিকে শুরুর দিকের দশ বছরেই বৈদেশিক বাণিজ্যে 'খ’-এর হাল এমন খারাপ হল, যে আগে 'খ’-এর এক টাকার বিনিময়ে 'ক’-এর যত মুদ্রা পাওয়া যেত, এখন, 'খ’-এর এক টাকার বিনিময়ে 'ক’-এর মুদ্রা পাওয়া যায় ৩০% কম।
এব্যাপারটা, এই ধরণের বাড়া-কমাগুলো খুব অস্বাভাবিক লাগার কথা নয়। যাঁরা একটু তথ্য, সংখ্যা, অঙ্ক খেয়াল রাখেন, তাঁদের এটা অস্বাভাবিক লাগার কথা নয়। মনে হবে, এমনটাই তো হচ্ছে, এর মধ্যে আর নতুন কথা কি!!
এই পর্যন্ত এই অর্থনীতির অঙ্কগুলো যিনি কষছেন, ইতিহাস-টা যিনি লিখছেন তিনি 'খ’-এর দুর্দ্দশার গল্প লিখছেন।
এবার ক্লাসে যেমন কিছু ত্যাঁদড় ছাত্র থাকে, সেরকম কেউ, ধরুন তার নাম 'দাশু’, প্রশ্ন করল,
এই আমদানি রফতানিটা কি বরাবরই এরকম ছিল?
তখন, মাস্টার মশাই উত্তর দিলেন, কই না তো!! বরং উল্টো ছিল। 'খ' থেকে সবথেকে বেশি রফতানি হত। আর 'প’-এর কথা কী বলা যায়! 'খ' থেকে সারা বিশ্বে 'প' রফতানি হতো।
তখন সে ছাত্র আবার জিজ্ঞেস করলো, তা তখন 'ক' কোথায় ছিল? ছিল না?
ছিল তো! ক তখন, 'খ’-এর থেকে বাকি বিশ্বে পণ্য রফতানি করত। 'ক’-এর দেশে বোঝাপড়াটাই ছিল এরকম – 'খ' থেকে পণ্য কিনে বাকি বিশ্বে বেচলে, পণ্য কিনতে যা খরচ হয়, বেচলে তার থেকে অনেক বেশি ফেরৎ পাওয়া যায়। কিন্তু 'খ’-এর 'প' পণ্য যখন 'ক’-এর বাজারকেও ছেয়ে ফেলল, তখন 'ক’-দেশে যারা 'প’-এর ধরণেরই পণ্য তৈরি করত, তারা চটে গেল। তাদেরকে শান্ত করতে আইন হল, 'খ’-এর পণ্য 'ক' সারা বিশ্বে বিক্রি করতে পারবে, কিন্তু 'ক’-এর নিজের বাজারে বিক্রি করতে পারবে না। যদি কেউ 'ক’-এর বাজারে, 'খ’-এর পণ্য বিক্রি করে, বা কেনেও, তাহলে, তার জরিমানা হবে।
একটা জোড়াতালি দেওয়া সমাধান হল বটে, তবে সে সমাধানে বেশি প্রাধান্য পেল, 'ক’-এর যে লোকেরা 'প' পণ্য নিয়ে সারা বিশ্বে বেচে বেড়াচ্ছে। 'ক’-এর যে লোকেরা 'প’-এর মতন পণ্য তৈরি করছে, তাদের কোন সুবিধে হল না। 'ক’-এর মধ্যে এবার দু-দল আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল। একদল 'ক’-এ পণ্য উৎপাদন করে বাকি বিশ্বে বেচতে চায় (যার মধ্যে 'খ’-ও আছে), আর একদল, 'খ’-এ উৎপাদিত পণ্য সারা বিশ্বে (যার মধ্যে 'ক’-ও আছে) সেখানে বেচতে চায়।

১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন-এর হিসেবে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশ কীভাবে কখন নিজেদের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করেছে। তথ্যসূত্র - আই এম এফ ও ম্যাডিসন। ছবিসূত্র নিউজিওগ্রাফি ডট কম।
১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন-এর হিসেবে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশ কীভাবে কখন নিজেদের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করেছে। তথ্যসূত্র - আই এম এফ ও ম্যাডিসন। ছবি সূত্র - নিউজিওগ্রাফি ডট কম।

এত পর্যন্ত লেখাটা তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে, কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছিল, ব্যাপারটা বোঝানো যাচ্ছে, না কি, জটিল হয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝার জন্য। এঁদের মধ্যে দুজন, যাঁরা একে অপরকে চেনেন না, তাঁরা বললেন, এত হেঁয়ালি করার কী আছে! বোঝাই তো যাচ্ছে, 'ক' হচ্ছে চীন। 'খ’-এর সঙ্গে ভারতের মিল আছে কিছু পুরোটা মিলছে না। 'প’-টা কি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু টেকনলজি, সফটওয়্যার, মেধা - এরকম কিছু হতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
আমরা বুঝতে পারলাম, হেঁয়ালিটা সত্ত্বর খোলসা করে বলা দরকার।
'ক' থেকে 'খ’-এ রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার গল্পটা ১৮১০ পরবর্তী সময়ের।
'ক' ব্রিটেন, 'খ' ভারত। আর 'প' মূলতঃ সুতি ও রেশম বস্ত্র যখন সেটা ভারত থেকে কিনে নিয়ে যাওয়া হত। আর ব্রিটেন থেকে ভারতে যখন আসত, মূলত মিলের সুতি ও টুইস্ট কাপড়।
তার ভিত্তি অল্প অল্প করে তৈরি হচ্ছিল, ১৭৮০ থেকে, মানে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অব্যবহিত পর থেকে। এখানে যে হিসেবটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা মূলতঃ ১৮৫০ অবধি। এই সময়টা ধরেই ফ্রী ট্রেড ডক্ট্রিন তৈরি হচ্ছে, গতি পাচ্ছে। বুলিয়ানিজম-এর বোঝাপড়া বাতিল হচ্ছে। মানে যে দেশের কাছে যত মূল্যবান ধাতু বা রত্ন আছে, সেই দেশ তত ধনী, এই বোঝাপড়াটা বাতিল হচ্ছে। কারণ ওই সব ধন-সম্পদ দেখা যাচ্ছে হাতে রাখা যাচ্ছে না।১৭২০/২১ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোট ধার ছিল ২৪ লক্ষ টাকা (এটা শুধুই আসলের অঙ্ক, এর মধ্যে সুদ ধরা নেই)। ১৭২৪ সালে কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ডাচেদের ধার ছিল ১৫ লক্ষ টাকা (এটা সুদ আর আসল মিলিয়ে)। এবং ১৭৪৭/৪৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধার দাঁড়ালো ৫৫ লক্ষ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা ধার নিতে, জগৎ শেঠ ( বাংলার তথা ভারতের তথা জগতের ব্যাংকার অর্থে, মাণিক চাঁদ – ফতেহ চাঁদ – মহাতব চাঁদ প্রমুখ)-দের কাছে যে বহুমূল্য ধাতু বা রত্ন গচ্ছিত রাখতে হত, তাতে বুলিয়ানিজম-এর শেষের দিন ঘনিয়ে আসছিল।
এসময়ে রিকার্ডো, স্মিথ, মিল-রা মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলছেন।

১৭৩০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে কতরকমের কাপড় কিনছে, তার তালিকা।ছবিসূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।
১৭৩০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে কতরকমের কাপড় কিনছে, তার তালিকা। ছবি সূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।

একই সঙ্গে, মিল, ভারতীয় ইতিহাস ডকুমেন্ট করছেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় ইতিহাস বোঝার একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করলেন, ভারতের ইতিহাসকে তিন পর্বে ভেঙে। হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ ভারত। আমরা আমাদের ইতিহাস চর্চায় মিল-কে প্রশ্নহীন আনুগত্যের সঙ্গে আত্মস্থ করে নিয়েছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ স্কলার এই বিভাজনকে প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করেননি, বা প্রশ্ন করা সমীচীন নয় বিবেচনায় এড়িয়ে গেছেন। কারণ পরবর্তীতে এটা প্রমাণিত হয়েছে, মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন একে প্রশ্ন করেছেন, তাঁরা কেউ মেনস্ট্রীম অ্যাকাডেমিয়ায় কল্কে পাননি।
ফলে ১৮১৮ থেকে ১৮৩৬ ওই কুড়ি বছরেরও কম সময়ে যখন, ব্রিটেন থেকে ভারতে বস্ত্র রফতানি ৫২০০ গুণ বাড়ছে, সেই একই সময়ে ঢাকার জনসংখ্যা দেড় লক্ষ থেকে কমে ২০,০০০-এ এসে ঠেকছে। কারণ যে মসলিন তৈরিকে ভর করে ঢাকা-র অর্থনীতিটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেটাকেই সম্পূর্ণ ধ্বসিয়ে দেওয়া গেছে।
এবার, এই হেঁয়ালি-টা করা কি খুব প্রয়োজন ছিল?
আজ্ঞে, আমাদের মনে হয়েছে ছিল। খুবই ছিল।
কারণ আজকে হ্যান্ডলুম, খাদি ইত্যাদি বিবিধ বোর্ডের অভিভাবকত্বের আবডালে বসে, কেউ যখন দাবি করেন, ভারতীয় হ্যান্ডলুম মানে, সেই মসলিন, সেই বুনন-কুশলতা, সেই জামদানি ইত্যাদি, ঐতিহ্য-গৌরব ইত্যাদি ইত্যাদি, যখন ফ্যাশনের দুনিয়ায় রিভাইভালিস্ট বলে একটা গালভরা নাম দাঁড়িয়ে যায়, সেইসমস্ত ডিজাইনাররা, তাঁতীদের সূচীশিল্পীদের সভায় প্রধান অতিথির পদ আলো করে বসেন, তখন, একটু সতর্ক হয়ে অন্ততঃ প্রশ্ন করতে পারার জন্যও এই হেঁয়ালিটা দরকার ছিল।

প্রথম যে সোনার সুচীশিল্পের মসলিন গাউনটার ছবি ছিল, ১৮১০-এর, বাঁদিকের গাউনটা সেটাই, পুরোটার ছবি।ছবিসূত্র - মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ম। আর ডানদিকের ছবিটা ১৮০০ থেকে ১৮০৫-এর একটা পোষাক। যে মসলিন গেছে ভারত থেকে, সেলাই হয়েছে ব্রিটেনে। ছবিসূত্র - ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়ম।
প্রথম যে সোনার সুচীশিল্পের মসলিন গাউনটার ছবি ছিল, ১৮১০-এর, বাঁদিকের গাউনটা সেটাই, পুরোটার ছবি।ছবিসূত্র - মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ম। আর ডানদিকের ছবিটা ১৮০০ থেকে ১৮০৫-এর একটা পোষাক। যে মসলিন গেছে ভারত থেকে, সেলাই হয়েছে ব্রিটেনে।
ছবি সূত্র - ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়ম।

ডিজাইনার-রা বা ব্যবসায়ীরা, বা সোশ্যালাইটরা, সচরাচর যাঁরা হ্যান্ডলুম বোর্ড গোছের জায়গাগুলোর পদ অধিকার করে থাকেন, তাঁরা কেউই কখনও সোচ্চারে এটা বলেন না যে, এই মসলিন আজকে তৈরি হয় না। তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং, নিজেদের তৈরি পোষাক, নিজেদের ব্র্যান্ড ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাঁরা এই মসলিন-এর সুতো এবং বুননের উত্তরাধিকার দাবী করেন।

আমাদের জানা অনুযায়ী, আজকের সময়ে এখনও পর্যন্ত হাতে কাটা সব থেকে সূক্ষ মসলিন। ছবিসূত্র - DW Studios-এর সুতাইরা শাড়ি।
আমাদের জানা অনুযায়ী, আজকের সময়ে এখনও পর্যন্ত হাতে কাটা সব থেকে সূক্ষ্ম মসলিন। ছবি সূত্র - DW Studios-এর সুতাইরা শাড়ি।

১৭৫৭-র আগে এমনকি ১৮০০ পর্যন্তও, এমন প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে বিদেশি পর্যটকেরা, এমনকী ব্যবসায়ীরা, ব্যবসায়ীদের নিযুক্ত প্রশাসকেরা (যাঁদের ক্ষেত্রে এই আচরণ তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী তাঁরাও) বাংলার সুতি ও রেশম বস্ত্র নিয়ে উচ্ছসিত। তাঁদের আরও আজব লাগছে, যে উৎপাদন যন্ত্র ব্যবহার করে তাঁতীরা ওই সূক্ষ্মতা তৈরি করছেন সেটা দেখে। কারণ ততদিনে, ভারতে, বাংলায়, বস্ত্র উৎপাদনের আলাদা আলাদা বিভাগে স্পেশালাইজেশন তৈরি হয়ে গেছে। এই স্পেশালাইজেশন যতটা না যন্ত্র নির্ভর তার থেকে বেশি মেধা, কৌশল ও কুশলতা নির্ভর। কারণ ইওরোপের তাঁতী এসময়ে একা হতে সুতোর টানা দেওয়া থেকে রং করা সব কিছু করেন। শ্রমবিভাজন তৈরি হয়নি। দক্ষতা তৈরি হয়নি। এগুলো খানিকটা টের পাওয়া যায়, ইওরোপে বটেই, এমনকি হলিউডেও একটু ভাল রিসার্চ করে যে পিরিয়ডিকাল ফিল্ম বা সিরিজগুলো তৈরি হয়, তার কস্টিউম ডিজাইন দেখলে।এই সময়ের অনেক আগে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আলাদা আলাদ রঞ্জক বা ডায়ারের মজুরিও নির্দ্দিষ্ট করে ডকুমেন্ট করা হয়েছে। সেখানে বঙ্গ এবং পুন্ড্রের কাপড়ের সূক্ষ্মতার বিষয়েও আলাদা করে উল্লেখ আছে। বাংলার ভারতের তাঁতিরা ইতিমধ্যেই জানেন, সুতো এবং প্রাকৃতিক রং দুটোই আসলে তন্তু, ফাইবার। তাঁরা মডার্ন্ট-এর ব্যবহার জানেন। কোন সুতোয় কোন রং ধরাতে কি মডার্ন্ট ব্যবহার করতে হবে, সে জ্ঞান তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নয়, পারম্পরিকভাবে অর্জন করেছেন। আর এগুলোর কোনটারই ধরতাই পায় না ইওরোপিয় প্রযুক্তির বোঝাপড়া। ফলে, তাদের পক্ষে অনেক সহজ হয়, ভারতীয় জ্ঞানের প্রতিটি প্রকাশকেই জাদু বা ডাকিনিবিদ্যা বা ব্ল্যাকম্যাজিক বা উইচক্রাফ্ট বলে দেগে দিতে। পরবর্তীতে পেশীশক্তির জোরে, সাংস্কৃতিক ভাবে ঔপনিবেশিকতাকে মগজে বয়ে চলা ভারতীয়দের মধ্যে এই কালাজাদুর ধারণা এমন এক ব্যজস্তুতির মতন গেঁথে দেওয়া যাবে যে, ২০২০-তে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ সেটা লিখবেন, কেউ কেউ আবার তার উত্তরও দেবেন। সোশ্যাল মিডিয়াকে সিরিয়াসলি না নেওয়ার জন্য আমরাও মাঝে মধ্যেই এখানে ওখানে টিপ্পনী গুঁজে যাবো।
আর, ইতিহাসকেও সিরিয়াসলি নেওয়ার তেমন কোন কারণ নেই। বরং সঠিক ইতিহাসের খোঁজটা আরও সিরিয়াসলি করা ভালো।
১৮৫১-তে, লন্ডনের বিশ্ব বাণিজ্য প্রদর্শনীতে বাংলার মসলিন দেখে সাহেবরা আহা-বাহা করছেন। যেখানে মূলতঃ শিল্প বিপ্লবের তাক লাগানো প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রদর্শন হচ্ছে।
১৮৬৬-তে, জন ফোর্বস ওয়াটসন, ক্যাটালগ বানাচ্ছেন, কালেকশনস অব টেক্সটাইল ম্যানুফাকচারার্স অব ইন্ডিয়া, আঠারো খন্ডে। এই লিখিত ডকুমেন্টেশন-এর কাজটা ইওরোপিয়রা গুছিয়ে করতেন।এই প্রকল্পটা সবথেকে দরকারি ছিল, ম্যাঞ্চেস্টার ও ল্যাংকশায়ারের মিল মালিকদের জন্য। যাঁরা ভারতের সুতি ও রেশমবস্ত্রের মতন কাপড় তৈরি করতে মারিয়া হয়ে উঠেছেন।

ফোর্বস-এর ক্যাটালগ থেকে - একদম বাঁদিকে, মুর্শিদাবাদের সোনা বোনা রেশম, আইটেম নম্বর ২৬৮, বাঁদিক থেকে দ্বিতীয়, ঢাকার সিল্ক-কটন, তার ওপরে সুতির এমব্রয়ডারি, আইটেম নম্বর ২৯৬, বাঁদিক থেকে তৃতীয়, মাদ্রাজের সোনা আর পাথর বসানো মৌমাছির ডানা এমব্রয়ডারি, আইটেম নম্বর ২৭০, আর একদম ডানদিকে নয়নসুখ মসলিন, আইটেম নম্বর ২৪৫।
ফোর্বস-এর ক্যাটালগ থেকে - একদম বাঁদিকে, মুর্শিদাবাদের সোনা বোনা রেশম, আইটেম নম্বর ২৬৮, বাঁদিক থেকে দ্বিতীয়, ঢাকার সিল্ক-কটন, তার ওপরে সুতির এমব্রয়ডারি, আইটেম নম্বর ২৯৬, বাঁদিক থেকে তৃতীয়, মাদ্রাজের সোনা আর পাথর বসানো মৌমাছির ডানা এমব্রয়ডারি, আইটেম নম্বর ২৭০, আর একদম ডানদিকে নয়নসুখ মসলিন, আইটেম নম্বর ২৪৫।

ফোর্বস তাঁর কাজ করেছেন। ওনার ওপর চটে গিয়ে এখন তেমন কোন লাভ হবে না। তবে, ডকুমেন্টেশন-এর শৈলীটা ওনার থেকে শেখার মতন। আর গোটা ডকুমেন্টেশনের কাজটা কখনই তার পারপাস থেকে সরছে না। গোটাটাই হচ্ছে মূল বিজনেস লজিকটাকে মাথায় রেখে। জন ফোর্বস ওয়াটসন, সেই মিল মালিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর উপলব্ধিটাও সাবধানবাণীর মত বলে রেখেছেন।
“In such manufactures the foremost place will be taken by that country which can most cheaply supply labor, intelligence, and refined taste—all three combined. This being the case, it is not probable that England will ever be able to compete successfully with the native manufacturer in the production of fabrics of this sort. The reverse, indeed, is in every sense probable, and the native looms will continue to yield the Embroideries, the Shawls, and the Carpets, for which they are already so famous. They will continue to do this for the customer in India, and it is quite possible, when the beauty of some of their productions is better known and appreciated, that they will find profitable customers in the far West as well. Such a hope is not without something to rest on, and it may be the sooner realized now that these collections have been made.”
মনে রাখতে হবে, এটা লেখা হচ্ছে, ১৮৬৬-তে। প্রযুক্তি, ইংলন্ডের মিল মালিকদের জন্য কোন অ্যাডভান্টেজ তৈর করতে পারে বলে ফোর্বস মনেই করছেন না।
“In the meantime the British manufacturer must not look for his customers to the upper ten millions of India, but to the hundreds of millions in the lower grades. The plainer and cheaper stuffs of cotton, or of cotton and wool together, are those which he has the best chance of selling, and those which he would be able to sell largely, if in their manufacturer he would keep well in view the requirements and tastes of the people to whom he offers them.”
এবং ডকুমেন্টেশনের কাজ করতে গিয়ে, ফোর্বস মোক্ষম বুঝেছেন, উচ্চকোটির ভারতীয়দের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী কাপড় বানানো ম্যাঞ্চেস্টার-এর মিল-এর কম্ম নয়। তার মাস নিয়েই থাকুক, ক্লাস নিয়ে নাড়াঘাঁটা না করতে যাওয়াই ভাল।

তুলো থেকে বীজ ছাড়ানো, টানার জন্য সুতো তৈরি, এরপরে রং হয়ে যাবে সলভিনস-এর আঁকা তাঁতীর কাছে। ছবিসূত্র - পাবলিক ডোমেন।
তুলো থেকে বীজ ছাড়ানো, টানার জন্য সুতো তৈরি, এরপরে রং হয়ে যাবে সলভিনস-এর আঁকা তাঁতীর কাছে। ছবি সূত্র - পাবলিক ডোমেন।
১৭৯৯-এর সলভিনস-এর তাঁতীর বোনা কাপড় বেচাকেনা হয়, ১৮০৯-এর লন্ডনের এই দোকানে। ছবিসূত্র ব্রিটিশ লাইব্রেরি।
১৭৯৯-এর সলভিনস-এর তাঁতীর বোনা কাপড় বেচাকেনা হয়, ১৮০৯-এর লন্ডনের এই দোকানে। ছবি সূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।
ফোর্বস যখন ক্যাটালগ বানাচ্ছেন, ক্যাটালগের আইটেমগুলো তখন বানাচ্ছেন এঁরা। আরও ঠিক করে বললে, এই ছবিগুলো ফোর্বস-এর ক্যাটালগ বানানোর আরও পাঁচ থেকে দশ বছর পরের ছবি।ছবিসূত্র - পাবলিক ডোমেন।
ফোর্বস যখন ক্যাটালগ বানাচ্ছেন, ক্যাটালগের আইটেমগুলো তখন বানাচ্ছেন এঁরা। বাঁ দিকে, দিল্লিতে সুতো তৈরি হচ্ছে, মাঝে, দিল্লির সূচীশিল্পী, ডানদিকে, ঘাটালের রেশম তাঁতী। আরও নির্দ্দিষ্ট করে বললে, এই ছবিগুলো ফোর্বস-এর ক্যাটালগ বানানোর আরও পাঁচ থেকে দশ বছর পরের ছবি। ছবি সূত্র - পাবলিক ডোমেন।
ওদিকে ফোর্বস নিজেই ১৮৩৫-এ ল্যাংকশায়ারে এই প্রযুক্তি দেখতে পাচ্ছেন। ছবিসূত্র - পাবলিক ডোমেন।
ওদিকে ফোর্বস নিজেই ১৮৩৫-এ ল্যাংকশায়ারে স্পিনিং মিল-এ এই প্রযুক্তি দেখতে পাচ্ছেন। ছবি সূত্র - পাবলিক ডোমেন।

আর অন্য দিকে এই একই সময়ে, ১৮৬১-এর ২২ জুলাই গভর্নর জেনারেল-এর ফরমান অনুযায়ী, প্রশাসনিক দায়িত্ব বিভাজন করে আলোচনা ফেঁদে বসা হয়েছে, ‘ভারতীয় তুলো তো একদমই পাতে দেওয়ার মতন নয়। ভারতীয় তুলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট প্রজাতির। ভারতীয়দের তুলো চাষটা শেখাতে হবে।’
কারণ ততদিনে বাজার হিসেবে ভারতবাসী শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে এসেছে। ব্রিটিশ পণ্যের মাথাপিছু ক্রয়ক্ষমতা, ১৮৫০-এ, ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রায় ১৪ শিঃ, চিলিতে ৯ শিঃ ৩ পেঃ, ব্রাজিলে ৬ শিঃ ৫ পেঃ, কিউবায় ৬ শিঃ ২ পেঃ, পেরুতে ৫ শিঃ ৭ পেঃ, মধ্য আমেরিকায় ১০ পেঃ, অথচ ভারতে তা মাত্র ৯ পেঃ । তাই এবার আর বাজার নয়, সস্তার কাঁচামালের জন্য ভারতের জমি, জল ও মানুষের শ্রমশক্তিকে ব্যবহারের ফিকির তৈরি হল। ফলে উপনিবেশগুলোতে সস্তায়, মিলের উপযোগী তুলোচাষ করার প্রকল্প নেওয়া হল।

১৮০০-র মাঝামাঝি পর্যন্ত এই যে মসলিনের  গাউনগুলো ইওরোপের উচ্চকোটির অভিজাত পরিবারগুলির স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করেছিল, সেই কাপড়ের উৎপাদন ১৮৫০-এর পর থেকে বন্ধ হয়ে এল। ছবি - ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম।
১৮০০-র মাঝামাঝি পর্যন্ত এই যে মসলিনের গাউনগুলো ইওরোপের উচ্চকোটির অভিজাত পরিবারগুলির স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করেছিল, সেই কাপড়ের উৎপাদন ১৮৫০-এর পর থেকে বন্ধ হয়ে এল। ছবি - ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম।

ভারত থেকে প্রথম ইংলন্ডে তুলো পৌঁছেছিল, ১৭৮৯ সালে। ১৭৮৯ থেকে ১৮১৮ পর্যন্ত ইংলন্ডের বাজারে তুলোর সরবরাহ দেওয়ার জন্য ভারত ও আমেরিকায় তুলো উৎপাদনে টক্কর নেওয়া প্রতিযোগিতা চলছিল। ১৮১৮ তে ইংলন্ডের বাজারে পৌঁছেছিল দুই লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বেল ভারতীয় তুলো, আর দু লক্ষ সাত হাজার বেল আমেরিকান তুলো। তারপরে, ভারতবর্ষ থেকে তুলোর যোগান অনিয়মিত হতে শুরু করে। ১৮২২-এ ভারত থেকে কুড়ি হাজার বেল তুলো পৌঁছয় ইংলন্ডের বাজারে। আবার ১৮৪১-এ ২,৭৮,০০০ বেল হয়ে ১৮৪৮-এ ৪৯,০০০ বেল। এর মধ্যে, ১৮৫০-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলো চাষে ঘাটতির কারণে, ইংলন্ডের মিল-এ বস্ত্র উৎপাদনে ক্ষতি হয়েছিল এক কোটি দশ লক্ষ পাউন্ড।

১৮৬৬-র ছবি। ছবিসূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।
১৮৬৬-র ছবি। ছবিসূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।

বৃটিশ শাসক কেন তুলো চাষ করতে চাইছে, সেটার নাহয় একটা কারণ বোঝা গেল। কিন্তু এই উলটপূরাণটা সম্ভব হল কি করে? মানে যে তুলো থেকে তৈরি সুতো, কাপড় ইত্যাদির খ্যাতি জগৎজোড়া, সেখানে ভাল তুলো চাষ হয়না, তারা ভাল তুলো চাষ করতে পারে না - এই বোঝাপড়াটা কীভাবে সামনে এল?
এর মধ্যে ভারতের বাজারে বিদেশী কাপড় ঢুকে, ভারতের বাজার ভাসিয়ে দিয়েছে। ভারতের তৈরি কাপড় বাইরে রফতানি হওয়া ততোধিক কমেছে।
এর মধ্য আরও কিছু ঘটনা সমান্তরাল ভাবে ঘটে চলেছে।
বৃটিশ বণিক বা শাসক কেউই বাংলার বা ভারতে উৎপাদন সম্পর্ক বোঝার দায় নেয়নি। নেওয়ার কথাও ছিল না। কিন্তু কোন অচেনা জিনিসকে বোঝার চেষ্টার থেকে, নিজেদের মতন করে ব্যবহারের স্বার্থে, ইওরোপিয়রা ডকুমেন্টেশনের কাজটা যে খুব ভাল বুঝতেন এ ব্যাপারে খুব সন্দেহ-র অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে আবার গণদেবতার জমি জরিপ-এর প্রসঙ্গে ফেরৎ যাওয়াটা আপাততঃ স্থগিত রাখা গেল। অন্য একজনকে ধরা যাক। ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন। বোট্যানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা এইসব কর্মকান্ডের পাশাপাশি, ভদ্রলোক দুটো সমীক্ষা করেছিলেন। একটা মাইসোরে, ১৮০০ সালে, আর একটা বাংলা-বিহার অঞ্চলে, ১৮০৭ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত। সার্ভে, তথ্যসংগ্রহের পদ্ধতি, একইসঙ্গে এরকম মাছ, গাছ টোপোগ্রাফি, জনসংখ্যা, পেশা, পারিবারিক আয়, পেশাভিত্তিক আয় এরকম যাবতীয় যা কিছুর তথ্য সংগ্রহের সমীক্ষার মুন্সিয়ানা নিয়ে যেদিন আলোচনা হবে, সেদিন ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটনকে নিয়েই গোটা আলোচনাও কম পড়তে পারে। আপাততঃ এটুকু এখানে প্রাসঙ্গিক, বুকাননের হিসেব মতন, বাংলা-বিহার অঞ্চলে, প্রতি দশজনে (পুরুষ, মহিলা, শিশু মিলিয়ে) একজন সুতো কাটা-র সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। এটা ১৮০৭ থেকে ১৮১৪-এর মধ্যে। ১৭৭০-এর চল্লিশ বছরের মাথায়। ১৭৭০ থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে এই অঞ্চলে কমবেশি এক কোটি মানুষ মারা গেছেন। বিহার ধরলে সংখ্যাটা দেড় কোটিতে পৌঁছবে। ১৮০৭ মানে, কাটনিদের সুদিন আর নেই। কিন্তু বুকাননের হিসেব থেকে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ১৭৫৭-র আগে বাংলা থেকে যে পরিমাণ বস্ত্ররফতানির উল্লেখ পাওয়া তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে, বুকানন-এর ১৮১০-এর এই দশজন-এ একজন হিসেবটা কোথায় দাঁড়াতো।
বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এই বিশাল উৎপাদক অংশের মধ্যের সম্পর্কটা বৃটিশদের অচেনা ছিল। জমি-র মালিকানা এবং জমি কেন্দ্রিক সামাজিক সম্পর্কের মতনই। তাই সময়-সুযোগ মতন স্বাধীন কারিগর ভিত্তিক উৎপাদনের বোঝাপড়াটাকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হল। ১৭৮২ থেকেই তাঁতিরা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কাপড় বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। কোম্পানি ছাড়া আর কাউকে কাপড় বিক্রি করা অপরাধ বলে কোম্পানি ঘোষণা করেছিল। স্বাধীন উৎপাদন বোঝাপড়াকে জোর করে ব্যাহত করার ফলে, একদিকে, কাপড়ের গুণমান কমতে শুরু করল। উৎপাদন কমল।তাঁতীরা পালাতে শুরু করলেন। তাঁতের সঙ্গে যুক্ত কারিগরের সংখ্যা কমতে থাকল।

ভারতের কারিগরি বোঝাপড়া। ১৮৬০-এর আশেপাশের ছবি। বাঁদিকে সোনার সূচীশিল্পের কারিগর, ডানদিকে রঙ্গরেজ-রা (ডায়ার)। ছবিসূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।
ভারতের কারিগরি বোঝাপড়া। ১৮৬০-এর আশেপাশের ছবি। বাঁদিকে সোনার সূচীশিল্পের কারিগর, ডানদিকে রঙ্গরেজ-রা (ডায়ার)।
ছবি সূত্র - ব্রিটিশ লাইব্রেরি।

এর মধ্যে, ম্যাঞ্চেস্টারের তুলো, নিকৃষ্ট বিবেচনায়, কাটতে অস্বীকার করলেন কাটনিরা। তাঁতীরা সে সুতোয় কাপড় বুনতে রাজি ছিলেন না। কারণ ম্যাঞ্চেস্টার-এ মিল-এর জন্য যে লম্বা আঁশের তুলো উৎপাদন হত, তা দিয়ে হাতে সূক্ষ্ম সুতো কাটা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে, যে ফুটি কাপাস-এর ছোট আঁশ থেকে সূক্ষ্ম সুতো বাংলার, বিশেষতঃ ঢাকার কাটনি-রা তৈরি করতেন, সেটা মিল-এ বোনা সম্ভব ছিল না, হাতে বোনাটাই একমাত্র সম্ভব ছিল।
ফলে, অত্যন্ত পদ্ধতিগত ভাবে, ফুটি কাপাস-এর চাষই বন্ধ করে দেওয়া হল। যে সূক্ষ্মতা নিয়ে বাংলার মসলিন-এর দুনিয়াজোড়া নাম, সেই মসলিন সুতো বন্ধ হয়ে গেল।
এরই মধ্যে, ১৮২০-তে লেখা সুতাকাটনির চিঠি, ১৮২৮-এর সংবাদ চন্দ্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। কাটনিদের রোজগার কী পরিমাণে কমেছে, ফলে সুতাকাটুনিরা কতটা দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে দিতেই, কাটনি ইংলন্ডের সুতোর নিকৃষ্ট মান-কে তাচ্ছিল্য করছেন – এই চিঠির গদ্য এবং তার স্যাটায়ারই আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে।
১৮৫০-এর মধ্যে বাংলার নিজস্ব গর্বের যে মসলিন তা বোনা বন্ধ হয়ে গেছে। এবং এমনটাই বন্ধ হয়েছে, যাদের বাকি ডকুমেন্টেশন-এর কাজ নিয়ে আমরা এত গদগদ চিত্তে কথা বললাম, তার কোন বীজও সংরক্ষিত নেই। কিছু বিক্ষিপ্ত ছবি পাওয়া যায় গুগুল করলে। আজ যে মসলিন তৈরি হয়, সেটা কোনভাবেই বাংলার মসলিন বলে যা পরিচিত ছিল তা নয়, তার ধারে কাছেও কিছু নয়। কারণ আমেরিকান বা ইজিপ্সিয়ান তুলো থেকে সেই সূক্ষ্মতা আনা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে যোগ করুন, মসলিনের সুতো কাটা আর বোনার বাকি শর্তগুলো। আবহাওয়া, দিনের কোন সময়ে, জলের কতটা কাছে বা দূরে ইত্যাদি। তুলো থেকে শুরু করে বাকি এই সবকটা শর্ত মিললে, তবে কাটনির কুশলতায় সেই সুতো পাওয়া সম্ভব ছিল। সেই তুলো নেই, দূষণ বেড়েছে, আবহাওয়া পাল্টেছে, কাটনি যা কখনও হাতে পাননি, তাঁর কাছে সেটা কাটার কুশলতা দাবি করার তো কোন মানেই হয় না।

ফুটি কাপাস। ছবি - পাবলিক ডোমেন।
ফুটি কাপাস। ছবি - পাবলিক ডোমেন।

তারপর থেকে আজও পর্যন্ত, জাহাঙ্গীর বা আওরঙ্গজেব-এর দরবারের ছবি বা মেরি আঁতোয়ানেতের ছবি রেফার করে কেউ, কোন ডিজাইনার বা বিক্রেতা যখন মসলিন নিয়ে কথা বলেন, তখন প্রথম বলা দরকার তিনি মিথ্যাচার করছেন। এই মিথ্যাচার, ব্যক্তির পরিবর্তে কোন দফতর, মন্ত্রক বা বোর্ড-ও করতে পারেন।

হ্যান্ডলুম বোর্ড তৈরি হওয়া থেকে যতদিন টিঁকে ছিল, ততদিনে, এই মিথ্যাচারে কারও কোন অসুবিধে হয়নি। প্রায়শই কেউ দাবি করছেন, ৫০০ কাউন্ট ১০০০ কাউন্টের সুতো তৈরি করছেন। কারিগর সংগঠনের বিশ্বেন্দু নন্দ-র একটা বড় সুবিধে হচ্ছে, তিনি নিজেকে ছোটলোক বলতে পছন্দ করেন। করেন, তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থান থেকেই। তিনি ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত হতে চান না, এই দাবি থেকে। বিশ্বেন্দু নন্দ-র সামনে একজন এরকম সব কাউন্টের দাবি করাতে, ভদ্রলোক ক্যাঁক করে ধরলেন, 'আমি একটু সেই কাটনির হাত আর চোখ দেখতে চাই। তারপরে নাহয়, তুলো আর চরকাও দেখা যাবে।' তারপরে আর তুলো, সুতো, কাটনি, চরকা কোন কিছু নিয়েই কোন উচ্চবাচ্য হল না।

ডিজাইন এবং ফ্যাশন-এর যুক্ত থেকে, সরকারি বা বেসরকারি ক্ষমতায় কেউ যখন, এরকম অবাস্তব দাবি দিয়ে নিজের কোন অ্যাজেন্ডা পারসু করতে চান, তখন সেই সব জায়গায় একজন করে বিশ্বেন্দু নন্দ না থাকলে যিনি বা যাঁরা থাকেন, তাঁরা ওই হিয়ারসে জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে মসলিন নিয়ে, জামদানি নিয়ে বিদ্ধ ও ঋদ্ধ হতে থাকেন। এর ওপর সেই শ্রোতাদের মধ্যে গণমাধ্যমের কোন প্রতিনিধি থাকলে, আর হালে সকলেই তো সামাজিক গণমাধ্যমে নিজস্ব প্রতিনিধি, তাঁরা এই শোনা জ্ঞান উজাড় করে দেন। সেটা করতে না পারলে তাঁদের দশা হয় ভবম হাজাম-এর মতন। ফলে গোছা গোছা ভুল ধারণা, ভুল জানা, এবং সেই জানার ওপরে ভুল আস্থা তৈরি হয়।

সুতাইরা-র গঙ্গাজল মসলিন শাড়ি। বাংলার তাঁতিদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হলেও, কাড়া যায়নি তার পরম্পরা সূত্রে অর্জিত জ্ঞান, তার শিল্পবোধ এবং দক্ষতা। এই স্বীকৃতিটা দিতে যদি কোথাও বিন্দুমাত্র আপত্তি হয়, তাহলে কোন রকম সরকারি উদ্যোগই কোন কাজে লাগবে না। ছবিসূত্র - DW Studios.
সুতাইরা-র গঙ্গাজল মসলিন শাড়ি। বাংলার তাঁতিদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হলেও, কাড়া যায়নি তার পরম্পরা সূত্রে অর্জিত জ্ঞান, তার শিল্পবোধ এবং দক্ষতা। এই স্বীকৃতিটা দিতে যদি কোথাও বিন্দুমাত্র আপত্তি হয়, তাহলে কোন রকম সরকারি উদ্যোগই কোন কাজে লাগবে না। ছবি সূত্র - DW Studios

তাই পাঠক যদি এতটা সত্যিই পড়ে ফেলে থাকেন, পড়তে গিয়ে এই লেখার দৈর্ঘ্য নিয়ে বিরক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে মনে রাখবেন, হ্যান্ডলুম বোর্ড যদি তার কাজগুলো ঠিক ঠিক করত, এত কথা বলা বাকি থাকত না।
তার মানে কি এই, যে হ্যান্ডলুম বোর্ড উঠে গিয়ে বেশ হল? না, হল না। কারণ রাষ্ট্রের, সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান-এ নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণের যে অধিকারটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা নাগরিক সমাজের হাত থেকে চলে গেল। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব কারা করবেন, ঠিক লোক করছেন কিনা, তাঁরা তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন কিনা, সেই অভিযোগের অজুহাতে হ্যান্ডলুম বোর্ড-এর থাকার যুক্তিটাকেই বাতিল করে দেওয়া কোন কাজের কথা নয়। কারণ তাতে, এরপরে যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হবে, সেগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির কোন মঞ্চই আর রইলো না। আগে যারা মঞ্চে উঠেছিলেন, তাঁরা দরকষাকষি করতে পারছিলেন না, করছিলেন না, নিজেদের আখের গোছাচ্ছিলেন বা নিতান্তই নিরুপায় ছিলেন, এগুলো কোনটাই সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দরকষাকষি করার প্রয়োজনীয়তাকে বাতিল করে না।
এই উপদেষ্টা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি, নাগরিক সমাজ শুধু নয়, কারিগরদের সরাসরি অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে টিঁকিয়ে রাখার জন্যও। এটা ঠিক, যে এতদিনে, সুতোর দামের ক্ষেত্রে কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণে, রেশম কীট বা তুলোর গুণমান বজায় রাখার জন্য, কৃষক যাতে ঠিকঠাক দাম পান তার জন্য, বিদেশের বাতিল হাতফেরতা প্রযুক্তি যাতে হাত-তাঁতকে সরাতে না পারে তার জন্য, তাঁতীর দক্ষতা ও কুশলতার সঠিক দাম দেওয়ার জন্য, এই পর্ষদ ঠিক কী কী করতে পেরছে, বা কী কী করার চেষ্টা করেছে সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা আছে, এরকম কাউকে আমরা অন্ততঃ খুঁজে পাইনি। তার মানে এমন নয়, এগুলো করার প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং কার্যকরী ভাবে এগুলো করতে গেলে, এই ধরণের পর্ষদ গুলোতে, সাধারণ নাগরিক সমাজের থেকে কারিগর সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বেশি প্রয়োজনীয়। সেটা করতে গেলেও, এটা অসম্ভব নয়, সম্পন্ন কারিগররাই প্রথম পছন্দ হবেন। কিন্তু তাঁতেও পর্ষদের কার্যকারিতা বাড়তে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দাবিটা জানানোর উপায় কি? কীভাবে?
শুরুর হেঁয়ালিটা শুধু এ কারণেই করা হয়েছিল, যে আলাদা করে টাইমলাইন-টা উল্লেখ না করলে ওটা আজকের পরিস্থিতির থেকে খুব দূরে নয়। কার্য-কারণ সম্পর্কগুলো খানিক বদলেছে, কিন্তু ফলাফলগুলো বিশেষ করে কারিগর বা তাঁতীর ভোগান্তি গুলো খুব বদলায়নি।
এর সঙ্গে এটাও উল্লেখ করা দরকার, গোটা তাঁত অর্থনীতিটার ভেঙে পরা, তাঁতীদের সমস্যা, চাষের ওপর তাঁতের সমস্যার ফেরতা প্রভাব, এগুলো কোনটা নিয়েই, বাংলার নাগরিক সমাজ থেকে তেমন জোরালো কোন প্রতিবাদের উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ ওপরে যে স্ট্যাটিসটিকস গুলো নিয়ে আমরা কথা বললাম, সেগুলো এমন নয় যে অনেক পরে কোন গবেষক বের করেছেন। বরং ১৮৫০ পর্যন্ত বাংলার সুতি ও রেশমবস্ত্রের ক্রমাগত অবক্ষয়ের তথ্যগুলো সংকলিত হয়েছিল ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৩ তেই। কিন্তু এদেশে তখনও বৃটিশের বিরুদ্ধে, কারিগর সমাজ, গ্রামীন যুথবদ্ধ সমাজ ছাড়া আর কোন প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছিল কিনা, না হলে কেন হল না, সেটা একটা প্রশ্ন বটে, কিন্তু তার উত্তর দেওয়াও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে খুব কঠিন নয়। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশী আন্দোলনের উচ্ছাসে বিদেশী পণ্য বর্জনের আবেগ যখন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন, এই স্বদেশী আন্দোলনের অর্থ সংগ্রহের জন্যই কটন মিল বসাচ্ছেন জাতীয়তাবদী নেতারা। সেখানে প্রযুক্তি ম্যাঞ্চেস্টার-এর। ফুটি কাপাস বা মসলিনের সুদিন তখনও খুব সাংঘাতিক অতীতের ঘটনা নয় কিন্তু। বড়জোর পঞ্চাশ-ষাট বছর। বাংলার তাঁত, তার অর্থনীতি এগুলো নিয়ে না ভেবে স্বদেশী আন্দোলন তৈরি হল, বিদেশী প্রযুক্তির হাত ধরে, যে প্রযুক্তি-র অপরিকল্পিত এবং বলপূর্বক প্রয়োগ ভারতীয় সমাজে শুধু ক্ষয়ের কারণ হয়েছে। বয়কট বা বয়কট নয়, এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কথা আমরা যত জেনেছি, ভারতের বা বাংলার পরম্পরাগত গ্রামীণ শিল্পকাঠামোর ওপর ভারতীয় সমাজের নিজস্ব প্রয়োজনীয় ধরণের শিল্পায়নের দাবি শুনিনি। অথচ সামাজিক জীবনের স্মৃতিতে যে সুতো, তাঁত এই ব্যাপারগুলো তখনও স্মৃতি হিসেবে যথেষ্ট জ্যান্ত, তার সবথেকে বড় প্রমাণ তো, ১৯২১-এ, গান্ধীর হাত ধরে, রাজনৈতিক চিহ্ন হিসেবে চরকার গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু তারপরে, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মানে, বৃটিশের জন্য চাষ করা তুলো থেকে কংগ্রেস কর্মীদের অপটু হাতে কাটা সুতোয় বোনা কাপড় হয়ে দাঁড়াল। এর রাজনৈতিক আবেগ অনস্বীকার্য, কিন্তু গ্রাম-বাংলার কৃষক ও তাঁতী-র তাতে কী লাভ হলো, সে খতিয়ান কখনও ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছে কি?
আজকের সময়েও, ঠিক সেরকমভাবেই, হ্যান্ডলুম (বা হ্যান্ডিক্রাফ্ট) বোর্ড তুলে দেওয়ার বিরোধিতা মানে, যদি শুধু মেলার আয়োজন করার দাবি হয়, এবং সেই মেলায় যদি একই রকমের ছাঁচে ঢালা পণ্যের সম্ভার হাজির করা হয়, তাহলে, সেটাও খুব কাজের হবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য সমস্যাটাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
তাই আলোচনাটা বরং উল্টোদিক থেকে শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয়। হ্যান্ডলুম, হ্যান্ডিক্রাফ্ট-এর জন্য আশু করণীয় কাজগুলো কি কি! আর সেই করণীয়গুলো ঘটিয়ে তুলতে গেলে, হ্যান্ডলুম বোর্ড কী করতে পারে! - এই দাবিগুলো কী কী, আর সেগুলো মেটাতে হ্যান্ডলুম বোর্ড-এর সদর্থক ভূমিকা কী থাকতে পারে, হ্যান্ডলুম বোর্ড-এ কাঁরা থাকলে এবং কাঁরা না থাকলে সেই ভূমিকা গ্রহণের সম্ভাবনা তৈরি হয়, প্রশ্নগুলো এরকম করে সাজিয়ে নিলে, উত্তর খোঁজার কাজটায় সুবিধে হয়।।

 [এই লেখাটায়, অনেক ধরণের রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। আলোচনা এগোলে সেগুলোর উল্লেখ করা যাবে। এবার বোধহয়, আরও একবার জোর দিয়ে বলা যায়, কেন এই বোঝাপড়া সংক্রান্ত লেখাগুলো কোন একজনের নামে যেতে পারে না। কারণ কোন একজন এই গোটা ক্যানভাস-টা কভার করেনি, অনেক মিলে করেছে। দুজন ব্যক্তি যাঁরা এই এডিটোরিয়াল টীম-এর বাইরে, তাঁদের নাম বলাটা প্রয়োজন। বিশ্বেন্দু নন্দ এবং অনির্বাণ নন্দী - এই দুজনের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জায়গার আলোচনা, এই বোঝাপড়াটা তৈরি করতে অনেক সাহায্য করেছে।]

এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।

তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।

যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।

আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।