কলকাতা কমন্স

২ এপ্রিল, ২০১৯। কথোপকথন থেকে সমূহ-র পথ চলা শুরু।
২ এপ্রিল, ২০১৯। কথোপকথন থেকে সমূহ-র পথ চলা শুরু। ছবি সূত্র - DW Studios

২০১৯-এর মার্চ মাসে (আরও নির্দ্দিষ্ট করে বললে, ২০ মার্চ, ২০১৯), নাট্যকর্মী তিতাস দত্ত, একটি নতুন পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য কিছু সহঅভিনেত্রীর খোঁজ করে, ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করেন।
যেহেতু, পুরোন অভিজ্ঞতার ডকুমেন্টেশন-টাও এই লেখাগুলোর একটা প্রয়োজনীয়তা, তাই, তিতাস-এর সেই ফেসবুক পোস্ট-টা (যেহেতু সেটি একটি পাবলিক পোস্ট ছিল), আমরা এখানে রাখছি।


'নতুন কাজ করব কলকাতায়,
কাজটা প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় - কোন ধারার হবে তা জানি না, তবে নাচতে গাইতে বাজাতে পারেন এমন কিছু অভিনেত্রী দের খুঁজছি।
এপ্রিলের ১ আর ২ তারিখ কলকাতায় তাঁদের সাথে আলাপ পরিচয়, কথা বার্তা বলতে চাই, তাঁদের সাথে স্পেস শেয়ার করতে চাই, এবং রাজনৈতিক এবং সৃজনশীল সহাবস্থান সম্ভব হলে একসাথে নতুন কাজটা বানাতে চাই।
যদি কেউ আগ্রহী থাকেন, আরো তথ্য জানতে চান, ৮৪৫২০৫৯৩৮৩ নম্বরে আমাকে ফোন করতে পারেন। বন্ধু দের জানাতে পারেন। যদি মনে হয় আমি এসব কিছুই জানি না, কোনদিন থিয়েটার করি নি, কিন্তু করে দেখলে মন্দ হয় না - Most Welcome, it's a privilege for us. আসুন দেখা করি। তারপর দেখা যাক।
জায়গা ও সময় খুব শিগগিরি জানাচ্ছি।
আশায় রইলাম।'

- তিতাস দত্ত, ফেসবুক পোস্ট, ২০ মার্চ, ২০১৯।

তিতাস-এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল, কথোপকথন-এর স্পেসেই। ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে, আর্ট কালেক্টিভ-এর অন্য একটি পারফরম্যান্স-এর সূত্রে। ফেসবুক পোস্টটি দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তিতাস কলকাতা কমন্স-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর ফেসবুক পোস্ট-এর উত্তরে যাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং ভাবনার আদান-প্রদানের জন্য, 'কথোপকথন'-কেই যে তিনি উপযুক্ত জায়গা ভেবেছিলেন সেটা আমাদের আরও ভরসা যুগিয়েছিল।
এরপরে, ২০১৯-এর এপ্রিল মাসে-র প্রথমদিন, বেশ অনেকজন মানুষ একসঙ্গে হলেন। ঠিকঠাক গুণতিতে, ২৩ জন। ওইদিনের প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পরে, ২০১৯-এর এপ্রিল মাসের দুই তারিখে তৈরি হল, সমূহ।
তিতাস-এর কথাতেই, সমূহ-র তৈরি হওয়াটাকে সবথেকে ভাল ব্যাখ্যা করা যায়।


"অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন 'তুমি সমূহ করলে কেন?’
আমি উত্তর দিয়েছি -'সমূহ আমি তৈরি করি নি, আমি আমার ব্যবসাবদ্ধ বুদ্ধি নিয়ে অভিনেত্রী খুঁজতে এসেছিলাম। সমূহ তৈরি হয়ে আমাকে তাতে শামিল করে নিয়েছিল।'
অনেকেই বিশ্বাস করেন নি। কিন্তু এ কথা সর্বৈব সত্য যে সমূহের বিশেষ কোনো কান্ডারী নেই। সমূহ সবাই মিলে চলতে থাকা একটা প্রচেষ্টা, তাই সকলেই কান্ডারী।"

তিতাস-এর সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ের সূত্রে যে যোগাযোগ-টার শুরু, কলকাতা কমন্স-এর সঙ্গে সেই যোগাযোগটা ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠিত হল সমূহ-র সঙ্গে। ফলে সমূহ-র গড়ে ওঠা এবং তার পরবর্তী কর্মকান্ডের ঘনিষ্ঠ সাক্ষী থাকার সুযোগ হয়েছে আমাদের। এই ঘনিষ্ঠতা আমাদেরও কিছু শিখিয়েছে। বিশেষ করে, দুটো ব্যাপার উল্লেখ করা জরুরি। এক, বিভিন্ন তেরচা মন্তব্যের মধ্যে দাঁড়িয়েও, একটা উদ্যোগ কীভাবে লিঙ্গ-রাজনীতির একটা স্টেটমেন্ট হয়ে উঠতে পারে।
"মেয়েদের ঐতিহাসিক ভাবে তুচ্ছার্থে নেবার কারণ আমাদের শরীর অনেক অনেক অত্যাচার জানে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা শিখেছি, এবং সেই গুণ গুলো আমরা এখন ধীরে ধীরে আইডেন্টিফাই করতে শিখছি। ছেলেদের শরীর ও ভিন্ন শর্তে পালিত হয়, তারাও মুক্ত নয়। কিন্তু মেয়েরা যেমন নিজেদের শরীর চিনতে শিখেছে বা শিখছে এবং "মেয়েদের মতো" থেকে "মানুষের মতো"র দিকে পথ হাঁটা শুরু করেছে, শরীর ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমনকি শরীর শিল্পী ছেলেরাও এখনো তার থেকে অনেক দূরে।"

এপ্রিল, ২০১৯। কথোপকথন-এ সমূহ-র হয়ে ওঠা। ছবি - DW Studios
এপ্রিল, ২০১৯। কথোপকথন-এ সমূহ-র হয়ে ওঠা। ছবি - DW Studios

দুই, বাইনারি লিঙ্গপরিচয়ের বিরুদ্ধে, সমূহ-র এই গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা আরও কিছু সমস্যার সমাধান তৈরি করল নিজস্ব ধরণে। অভিনয় হোক বা অন্য কোন রকম ভাবে, স্বাধীনভাবে, নিজস্ব শর্তে, শিল্পচর্চার যে কোন মাধ্যমের সঙ্গে জুড়ে থাকতে গেলে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদগুলো যোগাড়ের বন্দোবস্ত করতে হয়, তার জন্য টাকা-পয়সা খুবই প্রয়োজনীয়।
শিল্পচর্চার শর্ত-টা সমূহ আগেই ঠিক করে ফেলেছিল।
"কাজ টা মঞ্চে করতে চাই না।কলকাতার রং চং আলো আর সম্বর্ধনা যেখানে শেষ হয়, সেখানে আমাদের এই কাজ শুরু হবে। শহরের এমন কোনো জায়গায় করতে চাই না যেখানে থিয়েটার বোঝা দর্শক আসেন। কাজটা সেই সব জায়গায় করতে চাই, যেখানে মানুষ থিয়েটার দেখতে আসার কথা ভাবেন না, যাঁরা আমাদের এইসব সাংস্কৃতিক মহোৎসব থেকে বিচ্ছিন্ন, যাঁদের সাংস্কৃতিক খিদে বস্তা পচা সনাতনী চর্বিত চর্বন দিয়ে মেটাতে হয়। তাই এই কাজকে আকর্ষণীয় এবং রম্য হতে হবে। নাচ গান গল্পে ভরা হয়েও সেই নাচ গান গল্প বঞ্চনার কথা মনে করিয়ে দেবে, মনে করিয়ে দেবে প্রশ্ন করতে।"
এই শর্তে, শিল্পচর্চাই রোজগারের মাধ্যম হবে, এরকমটা হওয়া কঠিন ছিল। এমন নয়, সমূহ সেটা জানতো না।
"যে বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার এই চেষ্টা সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর থেকেও পয়সা নিতে বাধে। তাই এই ধরণের কাজের সঙ্গে যুক্ত বা সমব্যাথী মানুষ জনের সাহায্য চাইতে হবে, তাতে সবাইকে ভাগ নিতে হবে। সেটাও থিয়েটারের-ই কাজ।"
তাই শিল্পচর্চার পাশাপাশি, বিভিন্ন পসরা সাজালো সমূহ। কিছু, সমূহ-র মেয়েদেরই তৈরি। আরও কিছু, অন্য সূত্রে তৈরি হওয়া যোগাযোগের মাধ্যম বেয়ে এল। ধীরে ধীরে পসরার সম্ভার বেড়েছে। এই বাণিজ্যের থেকে উপার্জিত অর্থ, একটা পারফরম্যান্স থেকে অন্য পারফরম্যান্সের মধ্যে মেয়েদের বেঁচে থাকার, বাকি সমস্ত প্রতিকূলতার মহড়া নেওয়ার রসদ যুগিয়েছে।
এই সবকিছু মিলে, সদ্য পরিচিত এক দল মহিলার মধ্যে যে যৌথতা তৈরি হচ্ছিল তাকে আশ্রয় করে অল্প অল্প করে একটা নাটককে গজিয়ে উঠতে দেখা গেল – অথ হিড়িম্বা কথা।
সমূহ-র নিজস্ব বয়ানে,


"মেয়েদের পুরুষের কাজ করা উচিত নয়, কারণ তাহলে তারা রাক্ষস গুণ প্রাপ্ত হয়" - এক নেতার এই বক্তব্য থেকে আসলে এই নাটকের সূচনা। এর আগে আমরা ভাবতাম, রাক্ষস বুঝি এক জনজাতি, অনার্য্য, কিংবা রক্তখেকো কোনো দানব। 'কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত' এই বুঝি রাক্ষস গুণ. এই বক্তব্য শুনে বুঝলাম ঠিক তা তো নয়! তাহলে কেস টা কি? মেয়েরা 'পুরুষের কাজ করে' কি করে রাক্ষস হয়ে ওঠে; রাক্ষস গুণ ব্যাপারটা ঠিক খারাপই বা কেন?
রাক্ষসী হিড়িম্বার গল্পকে মাথায় নিয়ে 'অথ হিড়িম্বা কথা' অব্দি পৌঁছনোর রাস্তাটার পুরোটাই এই প্রশ্ন গুলোকে হাতড়াতে হাতড়াতে চলেছি আমরা। শরীর দিয়ে, মন দিয়ে, নিজেদের ব্যবহারিক অভ্যেস গুলো দিয়ে বুঝতে চেয়েছি রাক্ষসীর গল্প। কিন্তু রাক্ষসীর জবানবন্দিতে খুঁজে পাওয়া সেই গল্প কখনোই আমাদের চির চেনা মহাকাব্যের সাথে সহমত হাতে পারে নি। অতএব এ এক নতুন গল্প, অজস্র সেই সমস্ত গল্পের একটা যা পরাজিতের জবানবন্দি - যা মহাকাব্যে লেখা হয় না।"


এপ্রিলের দুই তারিখে, যে দল গঠিত হল, তাঁরা প্রথম পারফরম্যান্স করলেন, নভেম্বরের দুই তারিখ, SRFTI-এর অ্যাম্ফিথিয়েটার-এ।

অথ হিড়িম্বা কথা। নভেম্বর, ২০১৯।
অথ হিড়িম্বা কথা। নভেম্বর, ২০১৯।

এই সাতমাসে মহড়ার নিয়মিত জায়গা পাওয়া যায়নি। পেলে, তার জন্য খরচ অনেক, নিয়মিত সেখানে মহড়া দেওয়া সম্ভব নয়। বাংলা-র, কলকাতার গণতান্ত্রিক ও নাট্য আন্দোলন-এর ইতিহাস বেয়ে যে স্পেসগুলো তৈরি হয়েছিল, টের পাওয়া গেল, এমনকি সেই স্পেসগুলোতেও, থিয়েটার, নাটক গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতা ইত্যাদি সম্পর্কে সংবেদনশীল বলে পরিচিত মানুষেরা শুধুই মেয়েরা মিলে নাটক করছে এটা সবসময় হজম করতে পারেন না, চোঁয়া ঢেকুর তোলেন।
এই সাতমাসে, দলের মেয়েদের নিজ নিজ জীবনে স্রেফ মেয়ে হওয়ার কারণেই হওয়া সমস্যাগুলো বিন্দুমাত্র বিশ্রাম নেয়নি ও নিতে দেয়নি।
মফস্বল, জেলা শহর, গ্রাম থেকে কলকাতায় অভিনয় করতে আসা মেয়েদের, ঔপনিবেশিক শহুরে ইন্ডাস্ট্রি, দাদাগিরি-র দাপট দেখাতে ছাড়েনি।
কিন্তু তারপরেও নাটক হয়েছে। মানুষ দেখেছেন। তাঁদের ভাললাগাগুলো জানিয়েছেন।
আপনিও সমূহ-র উদ্যোগটার পাশে দাঁড়াতে পারেন। সলিডারিটি জানাতে পারেন।
আপনার পরিচিতি অনুযায়ী, যেখানে সম্ভব সমূহকে তার অথ হিড়িম্বা কথা-র শো নিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন।
সমূহ-র পসরা থেকে কেনাকেটা করতে পারেন।
রাস্তায়, ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে, মেট্রো স্টেশনে যদি দেখেন, একজন বা কয়েকজন মহিলা, লাঠি, ব্যানার ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছেন বলে, কোন সহনাগরিক বা কোন নিরাপত্তারক্ষী আপত্তি প্রকাশ করছেন, সহনাগরিক হিসেবে সেই মহিলাদের সমর্থনে এগিয়ে আসতে পারেন। সেটা শুধু এই কারণে নয় যে, আপনি পুরুষ হোন বা মহিলা, এই মহিলারা আপনারই কথা বলছেন। এই কারণেও যে, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে চলাফেরা করাটা সকলের অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেটা যদি অন্য কারও কোন অসুবিধে তৈরি না করে, তাহলে স্রেফ ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য সেটা নিয়ে আপত্তি করাটাকে যদি আজকে না আটকান, কালকে, আপনার চলাফেরাতেও, ক্ষমতা আপত্তি প্রকাশ করতে পারে। তাই তর্কের অভ্যাসটা তৈরি করা ভালো।
নাটকের শো-তে স্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন শৌচাগার-এর দাবীকে কেউ মেয়েদের প্যাকনা বললে, বা টেকনিশিয়ানরা মহিলা বলে, কেউ তাঁদেরকে অপমান করার ফিকির খুঁজলে, এই সমস্ত মানুষকে চুপ করানোর জন্য স্বাধীনভাবে আপনার যা ঠিক মনে হয় সেটা করতে পারেন।

অতিমারী একটা দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিকূলতা বাড়িয়েছিল। অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে নাটকের শো বন্ধ রাখতে হয়েছে। মহড়া করা যায়নি। এমনকি, কারও কারও রোজ দুবেলা খাবারের প্রয়োজনীয়তাকেও কখনও কখনও বিলাসিতা ঠেকেছে।
তারপরেও, সমূহ এবং অথ হিড়িম্বা কথা চলছে। চলবে।

 

এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।

তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।

যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।

আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।