কলকাতা কমন্স

এটা নতুন করে বলে দেবার প্রয়োজন না হলেও, সারা বিশ্ব জুড়েই ভাষামৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হার আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাষার প্রতি মানুষের দিনকে দিন বাড়তে থাকা অবিশ্বাস ও অমনোযোগের এই জমানায় এই কথাটা আমাদের সকলের পক্ষেই হয়তো মনে রাখা প্রাসঙ্গিক যে ভাষাই আমাদের একমাত্র আবাসন। মানুষ হিসেবে এই বিশ্বচরাচরের সঙ্গে আমাদের সার্থক কোনও যোগাযোগের প্রথম এবং প্রধানতম সেতু ভাষা। আমাদের সমষ্টিগত জীবন দাঁড়িয়েই আছে ভাষার ওপর ভর দিয়ে। ভাষা ছাড়া বাঁচতে চাওয়া অনেকটা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে চাওয়ার মত। অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু তলিয়ে ভাবতে গেলে(আমরা ভাবিও কিন্তু ভাষাতেই!)

এটা নতুন করে বলে দেবার প্রয়োজন না হলেও, সারা বিশ্ব জুড়েই ভাষামৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হার আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাষার প্রতি মানুষের দিনকে দিন বাড়তে থাকা অবিশ্বাস ও অমনোযোগের এই জমানায় এই কথাটা আমাদের সকলের পক্ষেই হয়তো মনে রাখা প্রাসঙ্গিক যে ভাষাই আমাদের একমাত্র আবাসন। মানুষ হিসেবে এই বিশ্বচরাচরের সঙ্গে আমাদের সার্থক কোনও যোগাযোগের প্রথম এবং প্রধানতম সেতু ভাষা। আমাদের সমষ্টিগত জীবন দাঁড়িয়েই আছে ভাষার ওপর ভর দিয়ে। ভাষা ছাড়া বাঁচতে চাওয়া অনেকটা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে চাওয়ার মত। অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু তলিয়ে ভাবতে গেলে(আমরা ভাবিও কিন্তু ভাষাতেই!)এটা চোখে না পড়ে উপায় নেই যে আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত অবিচ্ছেদ্যভাবে ভাষার সঙ্গে জড়িত। ভাষা না থাকলে কী হত? আমরা একে অপরের দিকে একটানা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু কোনও উপায় থাকত না এই মুগ্ধতাকে পরস্পরের কাছে পৌঁছে দেবার, পরস্পরের হৃদয়সংবেদী করে তোলবার। অনেকেরই মনে থাকবে গালিভারের বিস্ময়কর ভ্রমণকাহিনির সেই পর্বটির কথা যেখানে গালিভারের সঙ্গে দেখা হয় আকাশবিহারী লাপুতা শহরের সেই সব ভাষাবিজ্ঞানীদের যাদের গবেষণার বিষয় হল মানুষের জীবন থেকে শব্দকে এবং ভাষাকে কীভাবে ছেঁটে ফেলা যায়। তারা মনে করেন যে ভাষা ব্যবহার মানুষের মূল্যবান সময় আর প্রাণবায়ুর অহেতুক অপচয় মাত্র। তাদের অটুট বিশ্বাস যে সভ্যতার ও বিজ্ঞানের (বিজ্ঞান তো ‘সভ্যতা’রই সমার্থক, তাই না!) উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে ভাষার প্রয়োজনও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসবে, আর প্রকৃত সভ্য হবে তারাই যাদের কিনা কোনও দরকারই পড়বে না ভাষার। বিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষে পৌঁছে যাওয়া, আকাশে ভাসমান লাপুতা শহরের এই জ্ঞানীগুণী মানুষরা তাই মনে করেন যে সকলেরই উচিত নিজেদের পিঠে করে সেই সমস্ত জিনিসের ভার বয়ে বেড়ানো যা দেখিয়ে তারা আরেকটা মানুষকে অতি সহজে, ভাষা ছাড়াই, বুঝিয়ে দিতে পারবে যে তারা আদতে কীসের কথা বলছে, বা তাদের কী দরকার, বা কোন জিনিসটা এক্ষুনি না হলে তাদের চলছে না। হাস্যকর শুনতে হলেও, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের এই জমানায় ভাষার প্রতি এই ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস আর প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে ভাষার অপরিসীম ক্ষমতাকে খাটো করে দেখানোর এই ঝোঁক এখন সর্বব্যাপী।


অথবা হয়তো একটু ভুল বললাম। সমস্যাটা ভাষা নিয়ে ততখানি নয় যতটা ভাষাবৈচিত্র এবং বিশেষ বিশেষ কিছু ভাষা ও ভাষাগোষ্ঠীকে নিয়ে। বা বলা ভাল, হাতেগোনা ক্ষমতাশীল কয়েকটি ভাষাকে বাদ দিয়ে (যেমন ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ, জর্মন, ম্যান্ডারিন, হিন্দি) পৃথিবীর বাকি সমস্ত ভাষাকে নিয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে কমবেশি ৬৮০০টি কথ্য ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং ভাষাবিদ ও ভাষাকর্মীদের অনুমান যে এর মধ্যে কম করে দুই তৃতীয়াংশ ভাষা এই শতাব্দী শেষ হবার আগেই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হবে। বেঁচে থাকা ২০০০টি ভাষার মধ্যে, তথাকথিত প্রধান ভাষাগুলি ছাড়া অন্যান্য ভাষাগুলি তাদের আগেকার তেজ ও কার্যকারিতা হারিয়ে নাম কা ওয়াস্তে টিকে থাকবে মাত্র। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে এই বিলুপ্তির দিকে পা বাড়িয়ে থাকা ভাষাগুলোর অধিকাংশই আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মূল নিবাসী মানুষজনদের ভাষা, ইংরেজিতে বড় গলায় আমরা যাদের আজও ‘ট্রাইব’ বলে ডেকে থাকি। এই ভাষাগুলোর অনেকগুলোই আদ্যোপান্ত মৌখিক ভাষা, অর্থাৎ তাদের কোনও লিপি এবং লিখিত ইতিহাস নেই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্রেফ উচ্চারিত শব্দার্থের বিনিময়ের জোরেই তারা টিকে থেকেছে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। আমাদের মত লিখন-মুদ্রনকেন্দ্রিক ভাষাব্যবস্থায় লালিত মানুষদের পক্ষে মুখোচ্চারিত শব্দের প্রতি এইসব ভাষাগোষ্ঠীর অপরিমেয় বিশ্বাস ও সমীহ অনেকটাই অবোধ্য। ঠিক যেমন অবোধ্য এইসব ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, জীবনপ্রণালী, রীতিনীতি, সংস্কার বা এককথায় তাদের সামগ্রিক অস্তিত্বটাই। সারা পৃথিবী জুড়েই মূলনিবাসী মানুষদের জল-জমি-জঙ্গলের ওপর নেমে আসা কর্পোরেট সন্ত্রাসের সঙ্গে তাদের ভাষাগুলোর ক্রমঅবলুপ্তিকরণ যে সরাসরি যুক্ত, তা নেহাত অন্ধ না হলে অস্বীকার করা মুশকিল। আসলে ভাষা তো শুধুই কিছু বিশেষ্য বিশেষণ অব্যয় সর্বনামের যান্ত্রিক সমষ্টিমাত্র নয়, তার তৈরি হবার পেছনে রয়েছে একটি জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার বছরের পরিশ্রম। একটি ভাষা সেই ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর বহুশতাব্দীব্যাপী পরিশ্রম, যত্ন, কল্পনা আর বিশ্বাসের ইতিহাসকে নিজের মধ্যে ধারণ করে থাকে। তা এক প্রজন্মের অভিজ্ঞতাকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেয়, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ককে আলগা হতে দেয় না। সেই কারণেই ভাষা নেহাত অর্থবহ শব্দের ভাণ্ডার মাত্র নয়, তা একটি (বা একাধিক) জনগোষ্ঠীর স্মৃতিভাণ্ডারও বটে। তাই যখন পাখিদের সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বলতে বলতে বো ভাষার শেষতম প্রতিনিধি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর ৬৫,০০০ বছর পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের যাবতীয় সম্পর্কও চিরতরে হারিয়ে যায়। কোনই উপায় থাকেনা সেই ইতিহাস, সেই অভিজ্ঞতার কাছে আর কোনওভাবেই ফিরে যাওয়ার, কেননা প্রত্যেকটি ভাষাই পৃথিবীর দিকে চোখ মেলে তাকানোর একেকটা স্বতন্ত্র জানালা। সব জানালা দিয়ে যেমন পৃথিবীর একই রূপ ধরা পড়েনা, তেমনি ভাষা পাল্টে গেলে পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিও পাল্টে যেতে বাধ্য। প্রত্যেকটি ভাষার অভিজ্ঞতা, পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী, অন্যান্য ভাষার চাইতে স্বতন্ত্র। তাই ভাষাবৈচিত্রের অবলোপন আসলে পৃথিবীকে জানার, বোঝার ও বসবাসযোগ্য করে তোলার হাজারো একটা স্বতন্ত্র পথ ও পন্থারও অবলোপন। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ‘উন্নয়ন’ ও ‘অগ্রগতি’র যে একচোখা দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা পরিচালিত, ভাষাবৈচিত্রের ধারাবাহিক অবক্ষয় তারই অবধারিত ফলাফল। ‘উন্নয়ন’ ও ‘আধুনিকায়নে’র যে বয়ান পৃথিবী ও তার যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদকে যেনতেনপ্রকারেণ লুঠ করায় বিশ্বাসী, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্ত বিধ্বংসী পরিণাম চোখের সামনে স্পষ্টতঃ মজুত থাকা সত্ত্বেও, তার সঙ্গে সেই সব ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সরাসরি বিরোধ বাধা স্বাভাবিক যারা প্রকৃতিকেই নিজেদের আবাসন বলে মনে করেন, যারা প্রকৃতির দখলদারিত্বে নয় তার লালনপালনে বিশ্বাসী। তাই এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয় যে পৃথিবীর সবচাইতে বিপন্ন ভাষাগুলি আসলে আদিবাসী মূলনিবাসী মানুষজনদের ভাষা, আগ্রাসী শিল্পভিত্তিক আধুনিকায়ন যাদের জল-জঙ্গল-জমি ও বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ কেড়ে নিতে যে কোনও উপায় অবলম্বনে প্রস্তুত। আখেরে সবটাই কব্জির জোরের ব্যাপার, যার জোর বেশি মুলুকের শাসনভার তারই হাতে।


ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর মোট ১৯৭টি ভাষা এখন বিপন্ন, আর এই সংখ্যাটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ভাষামৃত্যুর (বা বলা যায়, ভাষাহত্যার) যা হার তাতে করে প্রতি মাসে অন্তত দুটি ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এত কম সময়ের মধ্যে এত অজস্র ভাষার চিরতরে হারিয়ে যাওয়া এক অদ্ভুত অন্ধকারময় ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করে। প্রযুক্তিবিদ্যার দৌলতে পৃথিবী যতই ছোট হয়ে আসছে, তার মধ্যে বৈচিত্রকে ধারণ করবার মত পরিসরও ততটাই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অথবা বলা উচিত, সংকুচিত করে দেওয়া হচ্ছে, কেননা এই দুটি প্রক্রিয়া মোটেই সমান্তরাল বা পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়। বরং একমুখী বিশ্বায়নের দাপট পরিকল্পিতভাবে পৃথিবীর ভাষাবৈচিত্রকে অর্থাৎ জীবন ও জগতকে দেখবার ও সেখানে বসবাস করবার হরেকরকমের পদ্ধতিকে নিজের সুবিধেমতন কাটছাঁট করে নিচ্ছে। বিশ্বায়ন ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীতে শুধু দুই রকমের ভাষা দেখতে পায়: প্রযুক্তির, জ্ঞানবিজ্ঞানের ও পণ্যসংস্কৃতির ভাষা বা তথাকথিত ‘প্রধান’ ভাষা, ল্যাঙ্গোয়েজ অফ নলেজ, এবং অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অনাধুনিকতার ভাষা, যেগুলো আসলে ‘অপ্রধান’, ল্যাঙ্গোয়েজ অফ দি ইন্ডিজিনাস। এই বাইনারির চোখ দিয়ে ভাষাবৈচিত্রকে দেখার মস্ত একটা সুবিধে হল যে এর মধ্য দিয়ে খুব সহজেই জ্ঞান বলতে কী বোঝায় তার একটা স্পষ্ট মানদণ্ড খাড়া করে দেওয়া যায় আর সেই অনুযায়ী দেগে দেওয়া যায় যে কোন ভাষাগুলো জ্ঞানচর্চার পক্ষে উপযোগী আর কোনগুলি নয়। যেগুলি নয়, তারা যে স্বাভাবিকভাবেই বাতিলের খাতায়, সে তো বলাই বাহুল্য। তখন তাদের জন্য বরাদ্দ হয় ‘ট্রাইবাল’, ‘ইন্ডিজিনাস’ জাতীয় কেতাদুরস্ত ক্যাটেগরি, যাদেরকে ব্যবহার করা হয় সজীব ও সচল একটি জনগোষ্ঠী, তার মানুষজন ও ভাষাকে জাদুঘরের দ্রষ্টব্য বস্তু হিসেবে জনসমক্ষে পেশ করবার জন্য। একটি ভাষাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য সবার প্রথম যা দরকার হয় তা হল ওই ভাষাভাষী মানুষকে মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া। সেটারই যেখানে অভাব, সেখানে হাজারটা সেমিনার বা ওয়ার্কশপ করেও সেই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়না। কেননা ভাষা বেঁচে থাকে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি জনগোষ্ঠী যদি ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষমতাবান একটি ভাষা ও সেই ভাষাভাষী মানুষের আদবকায়দাকে, নেহাত টিকে থাকার খাতিরেই, বেছে নিতে হয়। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় এই ধারাবাহিক স্থানান্তরণ ভাষার অবলুপ্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ। এ কথা ঠিক যে জীবিকার বাজারে টিকে থাকার প্রক্রিয়ায় মাতৃভাষা বাদেও অন্য আরেকটি প্রধান ভাষাকে আমাদের অবলম্বন করতেই হয়, বিশেষ করে আমাদের মত একদা উপনিবেশিত দেশগুলিতে। কিন্তু সেখানেও একজন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষকে স্রেফ ভাষাগতভাবেই যতখানি বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় তা যে একজন বাংলা কিংবা তামিল কিংবা হিন্দিভাষী মানুষকে হতে হয়না, সে কথা বলাই বাহুল্য। ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের প্রক্রিয়ার দিকে তাকালেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু করে দেবার এই প্রক্রিয়া পরিষ্কার ধরা পড়ে। আদিবাসী অধ্যুষিত ছোটনাগপুর মালভূমিকে কীভাবে বিহার, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে প্রতিটি রাজ্যেই এইসব জনগোষ্ঠীর মানুষকে সংখ্যালঘু করে দেওয়া হয়, সে ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে রয়েছে। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার না করেও তার সংশোধনের জন্য যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার, বিকল্প উন্নয়ন-কাঠামোর, বহুভাষী পাঠ্যবই তৈরির আশু প্রয়োজন, তার বাস্তবায়ন থেকে আমরা বহু দূরে দাঁড়িয়ে। বরং মূলনিবাসী মানুষদের তাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করে, খনিজসমৃদ্ধ সেইসব পাহাড়-জঙ্গল-নদীকে সম্পূর্ন নিষ্কাষিত করে দেবার জন্য বহুজাতিক কর্পোরেট সওদাগরদের হাতে তুলে দেওয়ার দিকেই আমাদের প্রধান ঝোঁক। সুবোধ ঘোষের সেই বিখ্যাত ছোটগল্পের কথা মাথায় রেখে বলা যায়, এ এক চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ, যেখানে কে বিজেতা আর কে পরাজিত তা আগে থেকেই ঠিক করা রয়েছে।


ভাষার কথা বলতে গেলে, ভাষা সংরক্ষণের কথা বলতে গেলে তাই প্রথমেই বলতে হয় সেই ভাষাগুলোয় যারা কথা বলেন, জীবনযাপন করেন সেইসব মানুষদের কথা। আর তা সম্ভবই না যদি আমরা ঠিক করে নিই যে উন্নয়নের একটাই মডেল, অগ্রসৃতির একটাই মানে, আধুনিকতার একটাই গ্রহণযোগ্য বয়ান আর যারা তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অসমর্থ বা অরাজি তারা সকলেই অনগ্রসর, অনুন্নত, অনাধুনিক। এই তথাকথিত উন্নয়নের নামে পৃথিবীকে ছিবড়ে করে দেবার যে পরিণাম আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, ভাষাবৈচিত্রের ক্রমঅবলোপন তারই একটি লক্ষণ। সম্ভবত, তার প্রধানতম লক্ষণ।

 

সূচনা চিত্রঃ প্যাটাগোনিয়ার প্রাচীন গুহাচিত্র

এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।

তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।

যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।

আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।