কলকাতা কমন্স

varavara rao twitter

অনীকের সঙ্গে দেখা হলে, খুব কিছু কথা থাকে না ওর।সাহিত্য-সিনেমা-রাজনীতি-খেলা-প্রেম-গান ইত্যাদি কোন কিছু নিয়েই নয়। পরশু যখন নিজের থেকে একটানা প্রায় দুমিনিট কথা বলা হয়ে গেল, আমি তখন, ফোনের ভয়েস রেকর্ডার-টা অন করেছিলাম। রেকর্ডিং-টা এখান থেকেই শুরু, তাই এখান থেকেই দিলাম।

অনীকের বয়ান (প্রথম কিস্তি)।।

গদর তখন আলতো সুরটা সবে ধরেছেন – ‘লা রে লা রে..’।
'ইন্দ্রাভেলি কোন্ডাল্লো’ গান-টা আমি সেবারই প্রথম শুনেছিলাম। আমি তখন খাতা কলম বাগিয়ে ভারাভারা রাও-এর সঙ্গে কথা বলছিলাম, সবাইকে তখন ভিভি বলতে শুনতাম, আমি, আমরাও তাই বলতাম।ইন্দ্রাভেল্লি-র আদিবাসী সংগ্রামের কথা তার আগে বই-এ, পত্র-পত্রিকাতে পড়েছি, সেটা একটা জেনারেল নলেজ ধরণের জানা ছিল।আমি শুনছিলাম।

Indravelly Massacre

 

ইন্দ্রাভেল্লির ইতিহাস ছাপিয়ে কখনও, ভিভি-র ব্যারিটোন-টা কানে বাজছিল।

এর আগে ভিভি, Kabir Suman-এর সঙ্গে আলাপ করে এসেছেন। ওনাকে খুবই ইম্প্রেসড লাগছিল। শান্তনু আর মেধা-রা সুমন-এর গান গাইছিল তার একটু আগে। কেউ যদি বেশি খাও খাবার হিসেব নাও – গান-টা শুনে এগিয়ে গিয়ে বসেছিলেন। গান শেষ হলে, জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার গান। সুমন-এর গান শুনে, মানে-টা বুঝতে চাইলেন। উনি যখন ঘাড় নেড়ে নেড়ে মানে-টা বুঝছিলেন, তখন, শ্রীদীপ ওর কেরামতি দেখানোর জন্য ধরেছিল, ‘Don’t give up, my friend’ – সুমনের সব গান-ই তখন ও ইংরিজি করার চেষ্টা করত। - এটা ছিল, ‘ছেড়েছ তো অনেক কিছুই’ – এর অনুবাদ। এতে ওই কাশির দমকের বাচিক অভিনয়টা করতে শ্রী খুব পছন্দ করত।
এসবের পরেই ইন্দ্রাভেল্লি-র ইতিহাস বলছিলেন ভিভি।
তার আগে গদর-এর থেকে ভিভি-র গল্প শুনেছি। ওরকম একটা নিটোল টাইট ভুঁড়ি নিয়ে, একটা লোক কীভাবে এক ছটফটে হতে পারে, না দেখলে বোঝা মুশকিল।
ওরকম ছেলেমানুষি ভঙ্গীতেই গদর বলেছিলেন, ১৯৯০-তে ওয়রেঙ্গল-এ যে দেড় কোটি মানুষের জমায়েত হয়েছিল, সেটার প্রকাশ্য নেতৃত্বে ছিলেন ভিভি।
দেড় কোটি!!! আমি বিশ্বাস করিনি। বরং একটু খারাপই লাগছিল, 'এহ, আমরাও এরকম বাড়িয়ে বলি?’ কারণ আমার ভিড় মাপার দৌড় তখন ব্রিগেড অবধি। পাঁচ, সাত, দশ লাখ নিয়ে ব্রিগেডের পরের দিন আনন্দবাজার আজকাল গণশক্তি-র মধ্যে দরাদরি হয়, সেটাই দস্তুর বলে জানি। পরে আমাকে আরও অনেকেই বলেছেন, পত্র-পত্রিকাতেও পড়েছি। সব জায়গায় ওই দেড় কোটি-র জমায়েতের কথাই বলা হয়েছিল।পরে কখনও আমার গদর-এর কাছে আর ক্ষমা চাওয়াটা হয়ে ওঠেনি। আমি যতবারই ভেবেছি, ততবারই মনে হয়েছে, কী বলব! আমি ওইদিন ভেবেছিলাম আপনি বড় গুলবাজ, ঢপ মারছেন!! এটা বলা হয়নি বটে, কিন্তু প্রথম দফার চেনা ছেলেমানুষিটা আমার পরের দিকে আরও বেশি ভাল লাগত।
ভিভি-র থেকে ইন্দ্রাভেল্লির গণহত্যা, আদিবাসীদের লড়াই-এর কথা শুনতে শুনতে আমার তখন মনে হচ্ছিল, এরকম একটা ব্যারিটোন, আর এই বাগ্মিতা থাকলে দেড় কোটি সংখ্যাটা খুব অসম্ভব নাও হতে পারে।
ব্যারিটোন মানে কিন্তু আমার কাছে সেসময় সুমন-ই একমাত্র। প্রয়োজনে আমি তখন অমিতাভ বচ্চন-এর ভক্তদের সঙ্গেও লড়ে যেতে পারি, সুমনের গলা অমিতাভ বচ্চন-এর থেকে ঢের ভালো এটা প্রমাণ করার জন্য।আর তখনও আমি জানতাম না, অমিতাভ ফিল্টার ছাড়া তাঁর গলা কেউ শুনুক এটা অ্যালাও করেন না। ঋতুপর্ণ ঘোষ, আনফিল্টার্ড ভয়েস ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন বলে বিপুল কেস খাইয়েছিলেন, কীং লিয়র সিনেমা-টার সময়।
সেদিন ওই প্রসঙ্গেই কথা বলতে বলতে, হঠাৎই ইংরেজিতে দুটো লাইন বললেন, লাইনদুটো এখন আর মনে নেই, কিন্তু তখন চেনা চেনা লাগছিল।
পাশে সিধু ছিল।ও তখন পরের মেনুটাকে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করছিল, কারিপাতা দেওয়া টক ডাল খেয়ে খেয়ে বেচারা খুব সমস্যায় ছিল, তাই এরপরে একবার সয়াবিনের তরকারি হতে পারে কিনা তাই নিয়ে একটা আলোচনা ফেঁদে সেটাকে মাস পিটিশনের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করছিল।
সিধু ঘাড় ঘুরিয়ে বলেছিল, ওটা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘তোমার কাজ/ আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়/ আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা’।
সিধু যেহেতু কবিতা ব্যাপারটা সবসময়েই সম্বর ডাল সম্পর্কে বিরক্তি আর কুচো করে কাটা সয়াবিনের ঝোলের থেকে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করত, তাই, ও-ও ভিভি-কে শুনিয়েছিল, প্রথমে বাংলায়, তারপরে ইংরিজি তর্জমা করে -
‘মাটি তো আগুনের মতো হবেই / যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও / তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না / যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।’
তখনই ওপাশে গদর 'লা রে লা রে...’ করে প্রায় বাচ্চাকে আদর করা মায়ের মতন গুণগুনিয়ে উঠলেন।
ভিভি চুপ। ওই ব্যারিটোন-এ অতক্ষণ কথা শোনার পরে, ওরকম একটা জাঁদরেল ঈর্ষনীয় গোঁফের তলা দিয়ে ওরকম একটা শিশুসুলভ হাসি - ওটা ঠিক বলে বোঝানো মুশকিল।
ওই প্রথম আমার শোনা, জল-জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আদিবাসীদের সংগ্রামের ইতিহাস, আর ইন্দ্রাভেল্লি কোন্ডাল্লা গান।
বয়সের কারণে, বন্দীত্বের চাপে ভিভি অসুস্থ, হয়তো কিছু অসংলগ্নতাও দেখা দিয়েছে। কিছু যায় আসে না।এই ভাবে খুব কম কিছু লোক বুড়ো হয়, কখনই না থেমে। যেটা আমি পারনি, আরও অনেকে পারেনি, বেশিরভাগই পারে না. তারা এরকম একজন মানুষকে শ্রদ্ধা করতে পারি, গলা ব্যাথা করে একটু, চোখ হয়তো ভিজে আসে। কিন্তু এগুলো সবই অবান্তর। এই দ্যাখ না, আজকে আবার আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার যে গ্র্যান্ড পরিকল্পনা হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে যদি ভিভি-র নাম আসতো, তাহলে ভিভি-র জীবন আর লড়াই-এর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান ইত্যাদি জানানোটা অনেক যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক হতে পারতো।

(ক্রমশঃ)

এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।

তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।

যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।

আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।