কলকাতা কমন্স

DW Studios-এর ওয়ার্কশপ-এর ছবি
DW Studios-এর ওয়ার্কশপ-এর ছবি

 এর আগের কিস্তিটা এত বেশি পাঠকের আগ্রহ তৈরি করতে পারবে, সেটা আমরা ভাবতে পারিনি। আগের অংশে আমরা ফুলিয়া বয়নশিল্পের শুরুর প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি। কীভাবে টাঙ্গাইল থেকে আসা উদ্বাস্তু বয়ন কারিগররা, নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে সম্বল করে, পারম্পরিক সামাজিক সমঝোতার জোরে, সরকারী অনুগ্রহ ছাড়াই, ফুলিয়াতে বসতি স্থাপন করলেন এবং বয়নশিল্পভিত্তিক একটা অর্থনীতি তৈরি করলেন।
এই প্রক্রিয়াটা ১৯৫০-এর দশকের একদম শেষ দিকে বা প্রায় ১৯৬০ ঘেঁষে শুরু হয়েছিল। চলেছিল ১৯৭০ দশকের প্রায় মাঝামাঝি অবধি। দেশভাগ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এই গোটা সময়কাল জুড়ে বিভিন্ন সময়ে এই বয়নজীবীরা এখানে এসেছেন। আর এই অভিবাসন প্রক্রিয়ায়, মহামারীর কোপে প্রায় উজাড় হয়ে যাওয়া ফুলিয়া, ফের সবুজ, জনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠল।

শান্তিপুর ক্লাস্টার নিয়ে, ২০১৫-র একটি গবেষণায় (A New Gate Way of Promoting Handloom Industry in Phulia - Chandan Das, Mithu Roy, Prosenjit Mondal), শান্তিপুর আর ফুলিয়ার বয়ন সমাজের মধ্যে বিভিন্ন রকম তুলনা করা হয়েছে। তার মধ্যে একটা অ্যাটিচিউডের তুলনা। বলা হয়েছে, শান্তিপুরের তাঁতীরা নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে ফুলিয়ার তাঁতীদের থেকে অনেক বেশি সময় নেন। তার ফলাফলটাও এরকমই আর একটা তুলনায় দেওয়া হয়েছে। ফুলিয়ার মোট উৎপাদনে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রফতানি হয়, যেখানে, শান্তিপুরে খুব বেশি হলে, মোট উৎপাদনের ২ শতাংশ রফতানি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিক চর্চায়, এগুলোকে সাকসেস স্টোরি হিসেবে ধরা হয়। আমরা আপাততঃ, এটা সাফল্য না ব্যর্থতা, এই বিচার থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চাইছি। আমরা শুধু এটুকু বলতে চাইছি, এবং জোর দিয়ে বলছি, যে, এটাই ফুলিয়াতে হওয়ার কথা ছিল। বা উল্টোদিক দিয়ে বললে, ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায়, বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদনকে সুনিশ্চিত করার জন্য ফুলিয়ার মডেলটাই প্রয়োজনীয় ছিল। এবং এই প্রয়োজনীয়া মেটানোর জন্য বাজার কোন দায়িত্ব নেয়নি। সামাজিক জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে, পুঁজির যোগানের জন্য সামাজিক সমঝোতাকে ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছে।
তার জন্য প্রয়োজন ছিল, দুর্ভোগে পড়া এবং বাঁচার জন্য মরিয়া একদল দক্ষ কারিগর, এবং সেই কারিগর সমাজের নিজস্ব বোঝাপড়া। ফুলিয়ায় উদ্বাস্তু হয়ে আসা বয়ন সমাজ সেই প্রয়োজনীয়তার শর্ত পালন করেছে। বাজার তার প্রয়োজনীয়তা মত তাকে ব্যবহার করেছে। টিঁকে থাকার প্রয়োজনে, ফুলিয়ার তাঁতীরা নিজেদেরকে আরও ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছেন।
এটা ভালো হোক বা মন্দ, সেই জাজমেন্ট যে যাঁর নিজের মতন করতে পারেন, যেটা জোর দিয়ে বলার, এই গোটা হয়ে ওঠাটার পিছনে, আর কারও কোন দায় নেই।
ফুলিয়ার আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক, পেশায় শিক্ষক, শ্রী নিলয় কুমার বসাক জানাচ্ছেন, ১৯৪৭-এর পরে পরেই, রাজমোহন বসাক, হেমলাল বসাক, মহেন্দ্র বসাক, ভীম বসাক প্রমুখরা টাঙ্গাইল-এর সুরুজ (টাঙ্গাইল-এর যে বাইশ গ্রাম থেকে বসাক-রা পশ্চিমবাংলায় আসেন বলে কথিত তার একটি গ্রাম) গ্রাম থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গে বসত স্থাপনের জন্য একটা ঠিকঠাক জায়গা খুঁজছিলেন। এঁরা সকলেই বৈষ্ণব মতাবলম্বী ছিলেন। ফলে, নবদ্বীপের কাছে, গঙ্গার পাড়ে, এবং তাঁত-এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো আছে এমন কোন জায়গার খোঁজে এঁরা, প্রথমে গুপ্তিপাড়া,পাটুলি ইত্যাদি ঘুরে, লোকমুখে শুনে সমুদ্রগড়ে এসে পৌঁছন। সেখানে এক সহৃদায় ব্যক্তি, গোপাল ডাক্তার-এর সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। নতুন করে বসতি স্থাপনের জন্য সমুদ্রগড় জায়গাটা তাঁদের পছন্দ হয়। গোপাল ডাক্তারের ব্যবস্থাপনায়, জমি কেনার বন্দোবস্ত হয়। লোকমুখে যা জানা যায়, পঁচাত্তর টাকা প্রতি বিঘা দরে তাঁরা জমি কেনেন। এই সমুদ্রগড়ে বসাকদের বসতি স্থাপনের শুরু।
ফুলিয়া প্রসঙ্গে, সমুদ্রগড়ে টাঙ্গাইলের বসাকদের বসতিস্থাপনের ইতিহাসটা কেন জরুরি, এবার সেটাকে পরিষ্কার করা যাক। টাাঙ্গাইলের বসাকদের যে অংশটা সমুদ্রগড়ে এসেছিলেন, তাঁদের বসতিস্থাপনের গোটা বিষয়টা অপেক্ষাকৃত পরিকল্পিত ছিল। এমনিতে বাংলার ইতিহাসে, এই ধরণটা খুব পরিচিত। কোন কারণে, গোটা গ্রাম বা গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা, এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপনের বিষয়টাতে একরকম সামাজিক অভ্যাস এবং পারদর্শীতা, বাংলার গ্রামসমাজে ছিল, আছে। ফলে, একটা ভৌগলিক স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, সমুদ্রগড়ে বসতি স্থাপনের অব্যবহিত পরেই এখানে বয়নের কাজ শুরু হয়ে যায়।
টাঙ্গাইল-এর শাড়ি মিল-এর সুতোতেই হতো। কিন্তু সম্ভবতঃ কলকাতার নৈকট্য, টাঙ্গাইল-এর যে বড় মহাজনেরা ইতিমধ্যেই কলকাতায় বসত তৈরি করেছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে, আরও অন্যান্য সুতো-র সহজলভ্যতা বাড়লো। বয়নজীবীরা নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সুতির সঙ্গে অন্যান্য সুতোর মিশেলে শাড়ি তৈরি করতে শুরু করলেন সমুদ্রগড়ে। পুরোন মোটিফগুলোর সঙ্গে নতুন ধরণের বুটি তোলা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন।
শ্রী নিলয় কুমার বসাক-এর গবেষণালব্ধ ধারণা অনুযায়ী, টাঙ্গাইলের বসাকদের যে অংশটা ফুলিয়া এসে পৌঁছলেন, তাঁরা সমুদ্রগড়ের পড়শীদের কাছ থেকে এই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলগুলো একদম হাতে তৈরি রকমে পেয়ে গেলেন। ফলে ফুলিয়া এসে টাঙ্গাইলের বসাকরা যে শাড়ি বুনতে শুরু করলেন, সেগুলো টাঙ্গাইল শাড়ি সম্পর্কে নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করলো। ফুলিয়া এসে টাঙ্গাইল শাড়ি তার নতুন চেহারা পেল। ফুলিয়া থেকে টাঙ্গাইল-এও সেই সমস্ত বয়নকৌশল পৌঁছলো।
১৯৬০-এর সময় থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত, ফুলিয়ায় এই অভিবাসনের প্রবাহটা চলছিল। উদ্বাস্তু তাঁতী আসছেন, তাঁত মহাজনদের বাড়িতে উঠছেন। মহাজনের বাড়িতে জায়গা থাকলে উঠছেন, না হলে মহাজন তার বসতজমিতে তাঁতীর জন্য ঘর তুলে দিচ্ছেন, সেখানেই তাঁত বসানো হচ্ছে, তাঁতী বুনতে বসছেন। এইভাবে মজুরির থেকে খানিক পয়সা জমলে, নিজের বসতের জন্য জমি কিনছেন, ঘর বাঁধছেন। সেই মহাজনের জমি হতে পারে, বা অন্য কারো। নিজের সঞ্চয়ের অতিরিক্ত বাকি অর্থের বন্দোবস্ত মহাজন করছেন। এবং তারপরে শ্রমের উপার্জনের বিনিময়ে ধীরে ধীরে সেই ধার শোধ করছেন। স্থানীয় সমস্যাও তৈরি হচ্ছিল মাঝে মধ্যে। কখনও মজুরি নিয়ে সমস্যা, কখনও বকেয়া ধার শোধ-এর কিস্তির পরিমাণ বা কিস্তির সংখ্যা নিয়ে। সমস্যাগুলো বাড়তো কমতো, যখন কলকাতা থেকে কাজের বরাতের পরিমাণ আর সুতোর দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে। কিন্তু এত পর্যন্ত সমস্যাগুলো সামাজিক ভাবেই মোকাবিলা করে নেওয়া যেত।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই সময়টা আরও অনেক বিষয়ের মতনই, ফুলিয়া (এবং হাত তাঁতের বাকি সমস্ত কেন্দ্র)-র অর্থনীতি-রাজনীতির ক্ষেত্রে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এর মূল যে উপাদান, তার শুরুটা অবশ্য অনেক আগে, উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। যে সময় থেকে, বৃটিশদের বদান্যতায়, আমাদের দেশে মিল-এর সুতো বোনা আরম্ভ হয়েছে। সেই স্পিনিং মিল-এর তুলোর যোগানের জন্য ভারতের দেশজ তুলোর বীজ-কে হাপিস করে দেওয়া হয়েছে। সুতো-কাটুনির জ্ঞান ও দক্ষতাকে অবান্তর করে দেওয়া হয়েছে। এবং মিল-এর সুতোতে কাপড় বোনা, ভারতের, বাংলার তাঁতিদের একমাত্র বিকল্প করে তোলা হয়েছে।

ফ্ল্যাশব্যাক ১| বয়নশিল্প আর সুতোকে আলাদা করার ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া এবং ঔপনিবেশিক শোষণ বিরোধি আন্দোলনেও ঔপনিবেশিক বোঝাপড়ার প্রভাব।

রজনীকান্ত সেনের কলমের প্রতি কোন রকম অশ্রদ্ধা না দেখিয়েই, এটুকু বলে রাখা দরকার, 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’-এর কথা বলে, যে স্বদেশী সলিডারিটি তৈরি করার চেষ্টা করলেন, মূলতঃ ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত, তাঁদের একবারও বাংলার তাঁতবস্ত্রের গৌরবের অতীতের কথা মনে হল না? মসলিন-এর গর্ব থেকে, মোটা কাপড়ের দৈন্যের ঘোষণার গোটা যাত্রাপথটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলেন না! এমনকী, বিভিন্ন গ্রেড ও ডিগ্রীর স্বদেশী-রা (কেউ পুরো স্বরাজ, কেউ আধা, কেউ তদারকি, কেউ বৃটিশদের স্নেহশীল অভিভাবকত্ব ইত্যাদি) আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহের জন্য নিজেরা যে কটন মিল খুলছেন সেটাও ম্যাঞ্চেস্টার-এর প্রযুক্তিতে। অথচ শহর কেন্দ্রিক ইওরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নেতাদের থেকে দূরে, গ্রামসমাজে দেশজ তুলো থেকে সুতো কাটার সামাজিক স্মৃতি ঠিক কতটা জ্যান্ত ছিল, সেটা টের পাওয়া যায়, গান্ধীজী যখন ১৯২১ নাগাদ চরকাকে আত্মনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির আইকন করে তুললেন।
১৮২৮-এর জানুয়ারির সমাচার চন্দ্রিকায় যে সুতাকাটুনির চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে, সুতো কাটুনিদের চরম দুর্দ্দশার সময়েও, একজন অদক্ষ সুতো কাটুনি কতটা রোজগার করতে পারতেন তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়। জমিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাগু করার সঙ্গে, বাংলার মহিলাদের সম্পত্তির যে দায়ভাগ উত্তরাধিকার ছিল, সেটাতেও খাবলা মেরে ঔপনিবেশিক আইন আগেই তৈরি হয়েছিল। তাঁতবস্ত্র ও সেই সঙ্গে কাটুনিদের সম্পন্ন অর্থনীতিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায়, ইসলামের জুজু দেখিয়ে, হিঁদুয়ানীর চক্করে রোজগেরে মহিলাদের রান্নাঘরে আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়াটাও সম্পন্ন হয়েছিল। নাহলে, ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী ভদ্রলোকি জেহাদ-এ, মহিলাদের অংশগ্রহণের জন্য ইওরোপীয় শিক্ষার প্রচলন-এর অপেক্ষা করতে হতো না। হতো না যে, তারই একটা প্রমাণ, ১৯২১ গান্ধীজীর চরকা-কে আইকন করে তোলার সিদ্ধান্ত এবং তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। প্রায় ১০০ বছরের পুরোন সামাজিক অভ্যাসের স্মৃতিকে রিলেট করতে গ্রামবাংলা এবং অন্যান্য ভূগোলের গ্রামীণ সমাজের কোন অসুবিধেই হয়নি। এই লিঙ্গরাজনীতির প্রসঙ্গে প্রয়োজন হলে, আমরা অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রাসঙ্গিকতার জেরে, এখানে শুধু এটুকুই বলার, ১৯৪৭-এর পরেও, ভারতের তুলো এবং সুতোর অর্থনীতিকে গায়েব করে দেওয়ার যে ঔপনিবেশিক চক্রান্ত, তারই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো। শান্তিপুরের পুরোন তাঁতকেন্দ্র বা সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, ফুলিয়ায় উদ্বাস্তুদের প্রতিষ্ঠিত নতুন তাঁত কেন্দ্রগুলোতে, সুতো শুধুই একটা বাণিজ্যিকভাবে কেনা কাঁচামাল হয়ে রইল। সেটা আর বয়নের উৎপাদনচক্রের মধ্যে রইলো না। (এই লেখাটা ঔপনিবেশিক আমলে বস্ত্রশিল্পের অবস্থাটা বুঝতে সাহায্য করতে পারে)।

ফ্ল্যাশব্যাক ২| ১৯৪৭ পরবর্তী সময়েও, বয়নশিল্প আর সুতোকে আলাদা করার ঔপনিবেশিক নীতির ধারাবাহিকতা।

ফুলিয়ায় যে সময়ে উদ্বাস্তু বয়ন কারিগররা বসতি স্থাপন করছেন, সেসময়ে মুম্বইতে, ভুলেশ্বরের একটা দুকামরার ফ্ল্যাট থেকে একজন ফাটকাবাজ, অংশীদারিত্বের ব্যবসা ছেড়ে, নিজের নতুন ব্যবসা শুরু করছেন। কারণ, অংশীদার চম্পকলাল দামানি যথেষ্ট ফাটকাবাজ নন। ভারতে বস্ত্রশিল্পের এই মহান মনীষীর নাম, ধীরুভাই আম্বানি। সুতো না কাপড় না, গুড় তা নিয়ে ধীরুভাই-এর খুব একটা কোন মাথাব্যাথা ছিল না। নেহাৎ সুতোর বাজারে দামের ওঠানামা, অনিশ্চয়তা বেশি, তাই ফাটকাবাজির জন্য তিনি সুতোকে বেছে নিয়েছিলেন। এবং তাঁর হিসেব ঠিক ছিল। অংশীদারিত্ব ছেড়ে নিজের ব্যবসা শুরু করার দশ বছরের মাথায়, তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সার্টিফিকেট পেয়ে গেলেন। ফাটকাবাজির জেরে একদিকে, সুরাট ও মহারাষ্ট্রের কটন স্পিনিং মিলগুলো যেমন ধীরুভাই-এর পায়ের কাছে গুটিয়ে বসছিলো, অন্যদিকে, প্রথমে রেয়ন, তারপরে নাইলন এবং শেষে ব্যাম্বার বা চামকি সুতোর আবিষ্কার আন্তর্জাতিকভাবে সুতো এবং বস্ত্রশিল্পে বদল আনছিল। ১৯৩০-এ আমেরিকায় আবিষ্কৃত রেয়ন-তন্তুতে তাও একরকম প্রাকৃতিক উপাদান থাকতো, উদ্ভিজ্জ সেলুলোজ। ১৯৫৪ থেকে ভারতে সস্তা শ্রমের কারণে রেয়ন উৎপাদন শুরু হয়েছিল। আর শুল্ক কম থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় ভারতে তৈরি রেয়নের বেশ ভালো চাহিদা তৈরি হয়েছিল। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত রেয়নের তন্তু থেকে তৈরি কাপড় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে বড় প্রভাব ফেলেছিল। এর মধ্যে ১৯৩৮-এ জার্ম্মানি এবং আমেরিকাতে প্রায় একই সঙ্গে নাইলন আবিষ্কার হয়। এমন তন্তু যেটা গোটাটাই পেট্রলিয়াম থেকে আসে। অন্যদিকে এই ১৯৩৮-এই আরব দেশে পেট্রোলিয়াম ভান্ডারের খোঁজ পাওয়া গেল। ১৯৫০ নাগাদ তেল তোলা এবং বিভিন্ন গন্তব্যে পাঠানোর পাইপলাইন পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। পঞ্চাশের দশকে, আমেরিকার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি শাসন করে ষাটের দশকে নাইলন ভারতের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করে। এতটাই যে, নাইলনের স্মাগলিং সরকারের একটা বড় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু নাইলন উৎপাদন তখনও সম্ভব ছিল না। ছিল না বলে, ভারত সরকার, দেশে উৎপন্ন রেয়নের রফতানির বদলে নাইলনের আমদানির প্রকল্প তৈর করল। ধীরুভাই-এর ফাটকাবাজির মৃগয়াক্ষেত্র তৈরি হল। একের পর এক হিন্দি ফিল্ম-এ যখন নাইলনের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি হয়ে গেল, ধীরুভাই তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, নাইলনের সুতো আমদানি করে বিক্রি করার থেকে, ম্যানুফাকচারিং আরও বেশি লাভজনক হবে। পোষাক আর সুতোর ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন তৈরি হল। আরও পরে, সুতো আর পেট্রোলিয়াম-এর ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন তৈরি হবে। তৈরি হল ভিমল ব্র্যান্ড। ১৯৭৫-এ ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক-এর টেকনিক্যাল টিম এসে, রিলায়েন্স-এর নারোদা টেক্সটাইল ইউনিট পরিদর্শন করে, ভারতের সবথেকে আধুনিক টেক্সটাইল কমপ্লেক্স-এর খেতাব দিল।

তো, ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষের পিরামিড কাঠামোয়, ১৯৫০-এর দশকের শেষ বা ১৯৬০-এর শুরুর থেকে, ১৯৭৫ পর্যন্ত ওপরের দিকের হাওয়া এরকম ছিল। আর নীচে, অনেক নীচে, উদ্বাস্তুরা বাসা বাঁধছিলেন, কাপড় বুনছিলেন। এবং সুতো-কে কাপড় বোনার প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে প্রক্রিয়া ব্রিটিশরা শুরু করেছিল, তাকে আরও পাকাপোক্ত করার সমস্ত রকম ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।
ওপর-নীচে যখন এই ছবি, তখন ১৯৭৪ সালে এল হ্যাঙ্ক ইয়ার্ন প্যাকিং নোটিফিকেশন।
হাত-তাঁতের জন্য সুতো প্যাক করার পদ্ধতি, পাওয়ারলুমের থেকে আলাদা। হাত-তাতের জন্য সুতোর ব্যবহার হয় মোড়া বা লেচি-র হিসেবে। হস্তচালিত তাঁতের জন্য তাঁত বুনতে শুরু করার আগে, আরও বেশ কিছু প্রক্রিয়া থাকে। যেমন, সুতো রং করা, প্রয়োজনে ভাতানো, মউরা, নলি পাকানো, ড্রাম হাটা এরকম বেশ কিছু কাজ থাকে, যেগুলো পাওয়ারলুমের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। এই কাজগুলোতে আরও অনেক মানুষ যুক্ত থাকেন, এবং প্রতিটি কাজেই বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এই কারিগরেরা কেউ তাঁতে বসতেও পারেন, নাও বসতে পারেন। এই জন্য আমরা বেশীর ভাগ জায়গায় বয়ন-কারিগর বলে উল্লেখ করেছি। তাঁতীরা বয়ন কারিগরের একটা অংশ মাত্র, কিন্তু তাঁতীরা ছাড়াও হস্তবয়নে আরও অনেক কারিগর যুক্ত থাকেন। সুতো থেকে তাঁতবোনার মধ্যের পর্যায়ের এই কাজগুলোর জন্যই হ্যান্ডলুমের জন্য সুতোর গাঁটরি করার এক বিশেষ পদ্ধতি আছে, যা পাওয়ারলুম থেকে আলাদা। কৃত্রিম তন্তু, মিল এবং পাওয়ালুমগুলোর প্রকোপে, হ্যান্ডলুমের জন্য সুতো যখন প্রায় অমিল হয়ে উঠছে, তখন, হস্তবয়নের কারিগরদের চাপে, এই নোটিফিকেশন জারি হয়। যাতে বলা হয়, মিলে যত সুতো প্যাক হবে, তার পঞ্চাশ শতাংশ হ্যান্ডলুমের প্রয়োজন অনুযায়ী প্যাক করতে হবে। সালটা ১৯৭৪। এর পরে দু দফায় এই বাধ্যবাধকতাটা কমিয়ে, প্রথমে চল্লিশ শতাংশ (২০০৩) এবং ২০১৯-এ শেষ পর্যন্ত ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এরপরেও মিল এবং পাওয়ারলুমগুলোর থেকে ক্রমাগত চাপ থাকে, এই তিরিশ শতাংশের বাধ্যবাধকতাকেও তুলে দেওয়ার জন্য।
ফুলিয়ার বয়নশিল্পের ইতিহাস বুঝতে এই কিস্তি-তে এত বেশি আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে আসতে হয়েছে, তাতে শব্দসংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। তাই এই কিস্তিটা এত পর্যন্ত।
মোদ্দা কথায়, আমরা দুটো অভিবাসন-এর ঘটনাকে সমান্তরাল ভাবে দেখেছি।
ধীরুভাই আম্বানি, ইয়েমেন-এর আডেন থেকে চাকরি ছেড়ে ভারতে ফিরে নিজের ব্যবসা শুরু করছেন, ১৯৫৮-তে। আর টাঙ্গাইল থেকে বসাক বয়নজীবীরা ফুলিয়ায় এসে বসতি স্থাপন করছেন ওই একই সময়ে। কিন্তু দুটি অভিবাসন প্রক্রিয়ার অভিমুখ আলাদা, অভিজ্ঞতা আলাদা।

তাঁতের যুত ও ফুলিয়ার তাঁত (১) - প্রথম কিস্তি-টা এখানে পাবেন।

এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখালেখি, সেটা কলকাতা কমন্স-এর বক্তব্য হোক বা কোন ব্যক্তি-র, সেটা, সেই বিষয়ে, একটা ধারণা তৈরি করার প্রক্রিয়ার অংশ।চূড়ান্ত কোন অবস্থান নয়, একটা অবস্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা।

তাই, এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'কলকাতা কমন্স’-এর যে কোন লেখা যে কেউ, প্রয়োজন বুঝলে, অন্য যে কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সেই ব্যবহারটা জানতে আগ্রহী।তাহলে এই চর্চা তৈরির চেষ্টাটা আরও ফলপ্রসূ হয়।

যে লেখাগুলো কলকাতা কমন্স-এর নয়, কোন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত, সেখানে, বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজস্ব। আমরা সেই বক্তব্যটা চর্চার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এই লেখাগুলো আমরা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করি। সেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেওয়া সমীচীন নয়।

আর এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কোন লেখা সম্পর্কে যে কোন প্রতিক্রিয়া কে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের ইমেল করতে পারেন, commons@kolkatacommons.org তে।