কলকাতা কমন্স

২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে, 'কলকাতা কমন্স’-এর উদ্যোগে শুরু হয় 'কথোপকথন'। আলোচনার একটা পরিসর তৈরি করার উদ্দেশ্য। বাক্যালাপের জন্য সামনাসামনি দেখা হওয়াটা জরুরি বলে আমাদের মনে হয়েছিল। এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে, শুধুই ইলেকট্রনিক কথোপকথন, বেশ কিছু সমস্যা তৈরি করছিল। সবথেকে বড় সমস্যা যেটা, সৌজন্যের অভাব। ওই অসৌজন্যটুকু ধার নিয়েই যদি বলা যায়, চার বছরের কথোপকথন সংগঠিত করার অভিজ্ঞতাও এর থেকে বিশেষ আলাদা কিছু নয়।বেশিরভাগ কথা চালাচালিই কোন মানে তৈরি করে না। না বললেও চলত, বা না বলাটাই সমীচীন ছিল, এরকম কিছু কথা নিয়ে অকারণ চাপান-উতোর। নিজেকে বড় আর অন্যকে ছোট দেখানোর জন্য, দাগিয়ে দেওয়ার একটা জান্তব উল্লাস কাজ করে - কত তাড়াতাড়ি বিপরীত পক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, ‘আপনি তো মশাই কিছুই জানেন না’। বা, 'এই বইটাই পড়েননি! পড়ে আসুন আগে!’ বলে খানিক ধমকে দেওয়া যাবে।

পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক্স-এর থেকে পাওয়া ফরম্যাটগুলোই জ্ঞানচর্চার একমাত্র ধরণ, এরকম একটা সংস্কারের বশবর্তী হয়ে, অন্য আলোচকদের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করা, নিজের বক্তব্যই একমাত্র ঠিক, এরকম মনে করার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, আমরা চেষ্টা করেছিলাম, বই পড়া জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতার মিশেলে একটা চর্চার পরিসর তৈরি করা। নাম দিয়েছিলাম কথোপকথন।

তাতে এই বদভ্যাসগুলো একদম প্রভাব ফেলছিল না, এমন নয়, অর্থহীন বাক্যালাপ হয়নি, এমনও নয়। যে কথা গুলো বলার কোন দরকারই ছিল না, না বললেই চলে, নিজের বুদ্ধি ও পান্ডিত্যের বোকা বিজ্ঞাপনগুলো অন্যরা টের পেয়ে যায়, সেগুলোও বলা হয়েছে বিস্তর।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, জেনেছি অনেক কিছু। ইতিহাস, পুরাণ, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পুরাণকে বোঝা, স্থানীয় ইতিহাস ও সেই ইতিহাসকে চেনার দৃষ্টিভঙ্গী, ফ্রী ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডীপ লার্নিং বা ব্লক চেন, শিল্পকলার ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ছবি, সিনেমা, নাটক এরকম অনেককিছু সম্পর্কে সমৃদ্ধ হয়েছি, যেগুলো কোনটাই হয়তো একা কেউ শুধু নিজে খুঁজে করে উঠতে পারতেন না।

হ্যাঁ, এই চর্চার থেকে কেউ বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার দাবি করলে সেটা ভুল হবে।তবে বিশেষ কোন জ্ঞানের অন্বেষণে সাহায্য করেছে আমাদের অনেককেই। কোন একটা জানার প্রক্রিয়াকে শুরু করিয়ে দেওয়ার, ধরিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা।এই শুরুর বিন্দুতে বা ওই ধরতাই গুলোর মধ্যে আটকে থাকলে, পল্লবগ্রাহীতার ভয় যথেষ্ট। তাই ধারাবাহিকতাটা প্রয়োজন। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন, এটা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত যে, কথোপকথন-এর উদ্যোগ, হয়তো খুব সীমিত সংখ্যাতেও, হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া সত্যের মতন দেখতে কিছু মিথ্যে-কে অন্ততঃ প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেওয়ার ফাঁড়া থেকে বাঁচিয়েছে।

কথোপকথন-এর অভিজ্ঞতাগুলো আমরা ক্রমশঃ একজায়গায় জড়ো করা এবং সেই সূত্রে ধারাবাহিকতাটা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই এখানে কথোপকথনের বিষয়গুলোকে ডকুমেন্ট করার পরিকল্পনা করেছি।

কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমাদের সামনে কিছু প্রশ্নও এসে দাঁড়াচ্ছে। আমরা জানিনা শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক কীরকম হবে। কথোপকথন-এর মূল ভাবনাটাকে কি লেখা অক্ষরে, শব্দে নিয়ে এনে ফেলা যায়? মানে, ধরা যাক, এরকমটা হলো, কোন লেখাই এখানে ঘোষিতভাবে সম্পূর্ণ নয়। যে কোন লেখা একটা শুরুর বিন্দু হতে পারে, বা যে কারোর যে কোন পর্যবেক্ষণ, সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত কোন আপডেট হোক, বা কোন সাম্প্রতিক খবর, বা কোন ঐতিহাসিক ঘটনা, বা কোন রাজনৈতিক বোঝাপড়া - এরকম যে কোন কিছু। সেখান থেকে সকলের অংশগ্রহণে, নিছক একটা লেখা নয়, একটা বোঝাপড়া গজিয়ে উঠতে থাকল। সোশ্যাল মিডিয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সর্বস্বতার কারণে, অনেক প্রয়োজনীয় কথা, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ একটা সময়ের পরে হারিয়ে যায়, খুঁজতে বেগ পেতে হয়। এখানে, কথোপকথন-এর এই পরিসরে সেটাকে নিয়মমাফিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব।

প্রাথমিকভাবে, এই কথোপকথনগুলো এক জায়গায় জড়ো করার একটা ঠিকানা আপাততঃ তৈরি করা সম্ভব হলে, ক্রমশঃ আমরা সকলে মিলেই সহজবোধ্য ও সুবিধেজনক একটা প্রযুক্তিও খাড়া করে ফেলতে পারবো মনে হয়। এব্যাপারে ওয়াকিবহাল কেউ যদি কোন পরামর্শ দেন, তাহলে সেভাবে ভাবা যেতে পারে।

শুধু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ হিসেবে যেটা বলে রাখার, আলোচনার, বাক্যালাপের সৌজন্যই কথোপকথন-এ যোগ দেওয়ার একমাত্র শর্ত। আর কথোপকথন একটা মঞ্চ মাত্র, তার নিজস্ব কোন মতামত নেই, কথোপকথনের উদ্যোক্তাদের থাকতেই পারে। কিন্তু উদ্যোক্তারাও আলোচনায় অংশগ্রহণকারী মাত্র। এর বাইরে, ‘কথোপকথন’-এ তাঁদের বিশেষ কোন অবস্থান নেই। টেকনিক্যলি কিছু কাজ করে দেওয়াটুকু ছাড়া আলোচনাগুলো চালিয়ে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি আলোচকদের মধ্য থেকেই একটা সংঘবদ্ধ উদ্যোগ তৈরি হয়, তত ভালো। এটা কীভাবে করা যেতে পারে, তা নিয়ে যদি কারও কোন পরামর্শ থাকে, জানাবেন।

শিশু অধিকারে দাবীসনদ

 আমাদের চাওয়াগুলো শিরোনামে কথোপকথন-এ নাগরিক সমাজের দাবীসনদ তৈরির উদ্দেশ্যে বারো দিন ধরে যে ধারাবাহিক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল তাতে গৃহীত প্রতিটি আলাদা দাবীসনদকে আমরা এক এক করে প্রকাশ করছি। কলকাতা কমন্স-এর পক্ষ থেকে আমরা শুধু মাত্র দাবীগুলো এক জায়গায় সংকলন করেছি। কোন সম্পাদনা বা সেন্সরশিপ আমাদের এক্তিয়ারে থাকার কথা ছিল না, আমরা সেটা করিওনি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করা সকলের অনুমোদন নিয়ে দাবীসনদগুলো এখানে প্রকাশ করছি।

১। শেষ দুপুর থেকে শরতের চিলতে ফিচকে রোদটা সল্টলেকের ওই বইঘরটাতে খেলে বেড়াচ্ছিল। সেখানেই সূত্রপাত হল আড্ডার। যে আড্ডা স্থানান্তর করে চলেও গেল খানিকবাদেই বাঁধা মন্ডপে। শুরু করলেন অঞ্জন সেন, কালে কালে দুর্গার আইকনের বিবর্তন নিয়ে। সঙ্গে অজস্র ছবি দেখানোর জন্য। একচালা থেকে আলাদা আলাদা চালায় দুর্গা, এক মাথা থেকে দশমাথা দুর্গা (রাবণের মত), আট থেকে আঠারো হাত এবং আঠারো পা বিশিষ্ট দুর্গার কথাও চলে এল। সঙ্গত করে যাচ্ছিলেন প্রিয় প্রতুলদা। কথায় কথায় বললেন কোথাও কোথাও সিংহকে দেখতে আবার ঘোড়ার মত হয়। অঞ্জনদা বললেন সিংহ কিন্তু সিংহ নয়, আসলে বিষ্ণু। সঞ্চালনা করতে করতেই তো শিখছিলাম। চট করে জানতে চাইলাম, ঘোড়া কেন?

রাত্রি অনেক হলে লিখতে বসেন চাকরীর চিঠি। দেখে ফেলবেন না কেউ প্লিজ। বন্ধুকে লিখছেন, পরিচিত-অপরিচিতকে লিখছেন - একটা কাজ, খানিক টাকা খুব দরকার। ঘাড়ের উপর দিয়ে নিঃশব্দে উঁকি দিচ্ছেন কেন? নিঃশ্বাস টের পেলেই লেখা-টেখা ফেলে, কালির দোয়াত উল্টে ফেলার সম্ভাবনা জাগিয়ে সশব্যস্ত উঠে দাঁড়াবেন। একবার আপনার দিকে, একবার লেখার দিকে চেয়ে সপ্রতিভ হতে গিয়ে অট্টহাস্যের চেষ্টা করবেন। পুরো হাসিটা কোনদিনই শেষ করতে পারেননি। মাঝপথে হাসিটা গলার কাঁটার মত আটকে দু-হাত পা জড়োসরো, দাঁড়িয়ে থাকবেন মাথা নীচু করে। চোর দায়ে ধরা পড়ে গেছেন। তিনি বাংলা আধুনিক কাব্যসাহিত্য, তিনি মেসবাড়িতে কোনরকম, ভাড়া বাড়িতে একলা ঘরের ছারপোকাময় তক্তপোষে। কবিকে এভাবে লজ্জা দেবেন না। তাঁর কোন আরাম কেদারা নেই। তেমন স্থিরচিত্র তাঁর পাওয়াও যায় না। অনুগ্রহ করে এভাবে যাবেন না কখনো। চিঠি লিখবেন বরং। 'শ্রদ্ধেয় জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু...'।

অতিথি পুলিশ আধিকারিক বললেন 'I love lock-up'। কেন না, লক আপের পেছনে অপরাধ চলে যায় বলে নাগরিক কিছু শান্তি-স্বস্তি পেয়ে থাকে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষটি শুনেছিলেন পুলিশ মানেই দুর্নীতিগ্রস্ত। করবেন না করবেন না করেও শেষে পুলিশের চাকরী নিয়েছেন। একটাই ব্রত, অপরাধ মোকাবিলার। এবং উনি খুব পরিস্কার জানেন উঁচু উঁচু স্কাইরাইজে বসে থাকা হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের চাইতে বড় চোর-ডাকাতও না। দৃপ্ত হয়ে ওঠা মানুষটিকে এরপরেও আমাদের জানাতে হয় পুলিশ ও বিচারক তো এক নয়। দুটো কাজ একহাতে চলে গেলে যে পর্বান্তর হয় তাতে আইনের সীমানা লঙ্ঘিত হতেও পারে/হয়ে থাকে। অতিথি আরেক বন্ধু অফিসার জানালেন সেই ঘটনা যেখানে অন্যায্যভাবে কাউকে অপরাধী করার প্রচেষ্টা তাঁরা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কেমন করে রুখেছেন।

সাহিত্যের আজ ও কাল, কাল ও আজের সাহিত্য

কালবৈশাখীর পরে। নীলচে বিকেল ভাগশেষের মত পড়ে আছে। আড্ডা আলোচনার অতি উত্তম লগ্ন। শুদ্ধসত্ত্ব বড়ো সহজ সঞ্চালক নন। শুরুতেই প্রশ্ন কে কে লেখেন না? কী লিখি? কেন লিখি? লেখার ভাল মন্দ হয়? বুঝি? উত্তরে চায়ের পেয়ালা হাতে শুরু হল কথোপকথন। লেখকের বয়ঃসীমা আছে? লেখকের সংজ্ঞা কী? লিখলেই কি লেখক হওয়া যায়? চাই প্রচার। চাই প্রকাশ। বাণিজ্যিক সাফল্য না এলে কিসের লেখক? স্বীকৃতিই আসল? লেখার প্রসারটাই গুরুত্বপূর্ণ? তাহলে যে কোনো রাজনীতিক লেখক হতে পারতেন? তেমনটা তো হয় না?

নন্দলাল বসুর এই ডিজাইন দেখে আমাদের শুরু হয়েছিল সহজ পাঠ। মনে পড়ে? কথোপকথন পেজে এটা মনে করিয়ে দিলেন এক বন্ধু। প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়তে আপনি যাবেন বিলেত? সুকুমার রায় গিয়েছিলেন। সন্দেশের অফিসে উপেন্দ্রকিশোর থেকে সত্যজিত অবধি আমরা যা ছবি দেখেছি, ভারতবর্ষের কোনো ছাপাখানায় তখনো তা হয়ে ওঠেনি। চাঁদের পাহাড়ের ইলাস্ট্রেশন আর কভারে সত্যজিত যেটা করেছিলেন অনেক অনেকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম সেটার দিকে। স্মার্টফোনে আজকাল দেখি সেটা নাকি ম্যাজিক পেন।

এমনিতেই কৌশিকী অমাবস্যা পড়ে গিয়েছে। কী বলতে কী হয়! সাঁঝ লাগছে এমন সময় হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে কর্তাগিন্নী যেই উপস্থিত হলাম DW Studios, দুম করে শুরু হয়ে গেল ঢপের থিয়েটার।কী দেখলাম? উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ারের বিনির্মাণ? কাপ্তেনবাবু আর বীরকৃষ্ণ দাঁয়ের একপেশে খেলার হাইলাইটস এই সময়ের পর্দায়? নাকি এই থিয়েটার দেখার চেয়ে বেশী কিছু। ইন্টিমেট থিয়েটারে স্টেজ আর চেয়ারের কোনোও দূরত্ব নেই। ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে আজকের ময়নাকে যখন শরীরের নানা ভাঁজে আঘাত করে আঙুর, সহ্য হয় না, চোখ ফিরিয়ে নিই কেন বারবার? আমাদের আঙুলের ডগায় ফেসবুক ইউটিউব নেটফ্লিক্স এর চেয়ে অনেক ঘোরতর হিংস্র দৃশ্যের নেশা লাগিয়ে আমাদের বিঞ্জ ওয়াচ করায়। তাহলে ইন্টিমেট থিয়েটারের ধরনটাই এটা যে দর্শক ঐ পরিধির মধ্যে ঐ ফিকশনের অংশ হয়ে যায়? দূরত্বটাই মায়াবাস্তব তৈরী করে তাহলে? ইন্টিমেট থিয়েটার এক আশ্চর্য সামাজিক এক্সপেরিমেন্ট বটে।